নওগাঁর ঐতিহাসিক কুশুম্বা মসজিদ সাড়ে ৪০০ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে বিস্ময় সৃষ্টি করে দাঁড়িয়ে আছে। মুসলিম স্থাপত্যের অনুপম আর অপূর্ব নিদর্শনে তৈরি এ মসজিদ দেখতে অসংখ্য নারী-পুরুষ প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে আসেন।
কুশুম্বা মসজিদের তিনটি প্রবেশদ্বারের মাঝেরটির ওপর আরবি হরফে বা অক্ষরে নামাঙ্কিত বা লিখিত ৭.৭ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও ৮ ইঞ্চি প্রস্থের যে শিলালিপি দেখা যায়, তাতে মসজিদের নির্মাণ সাল উল্লেখ করা হয়েছে। তার ওপর ভিত্তি করে কুশুম্বা মসজিদের নির্মাতা হিসেবে যার নাম উৎকীর্ণ করা আছে, তিনি হলেন সোলায়মান খান। তিনি তৎকালীন কুশুম্বা গ্রামের চিলমন মজুমদার নামে একজন হিন্দু জমিদার ছিলেন। তিনি তার জমিদারির রাজস্ব পরিশোধে ব্যর্থ হলে একসময় কারাগারে বন্দী হন। অবশ্য পরে তিনি নিজের ইচ্ছায় সপরিবারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সোলায়মান খান নাম ধারণ করে বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভ করেন। কিছুকাল পর তিনিই নিজ অর্থ ব্যয়ে কুশুম্বা মসজিদের আংশিক বাকি নির্মাণকাজ শেষ করেন। তবে এ নিয়ে মতভেদ আছে, কুশুম্বা মসজিদের নির্মাণকাজ সুলতান আলা-উদ-দীন হোসাইন শাহের শাসন আমলে শুরু হয়েছিল। শামস উদ-দীন আহম্মদ কৃত ও রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘ওহংপৎরঢ়ঃরড়হ ড়ভ ইবহমধষ ঠড়ষ-ওঠ’ গ্রন্থের ১৫৫ পৃষ্ঠায় লিখিত একটি তথ্য মতে রাজশাহী জেলা পরিষদের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সুরেন্দ্র মোহন চৌধুরী কুশুম্বা মসজিদের পশ্চিমে সোনাদীঘির দক্ষিণ পাড়ের ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি শিলালিপি আবিষ্কার করেন। এতে ধ্বংসপ্রাপ্ত সোনা মসজিদ খ্রিষ্টাব্দ ১৪৯৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর মোতাবেক আরবি ৯০৪ হিজরির ১৩ জমাদিউল আওয়াল তারিখে নির্মিত হয়েছিল। এ কারণে কুশুম্বা মসজিদটিও হয়তো এ সময়ের কাছাকাছি কোনো সালে নির্মিত হয়ে থাকতে পারে বলে অভিমত রয়েছে। কারণ কুশুম্বা মসজিদের কেন্দ্রীয় মিহরাবের ওপর স্থাপনকৃত শিলালিপিটি সুলতান আলা-উদ-দীন হোসাইন শাহের আমলের ছিল এবং মসজিদের কেন্দ্রীয় দরোজার ওপরে স্থাপনকৃত শিলালিপিতে সুলতান গিয়াস উদ-দীন বাহাদুর শাহের নাম লিপিবন্ধ আছে। আর সুলতান গিয়াস উদ-দীন বাহাদুর শাহের আসল নাম ছিল খিজির খান। তিনি আফগানিস্তানের শাসক ছিলেন। সুলতান গিয়াস উদ-দীন বাহাদুর শাহ বা খিজির খান ঝনেক সোলায়মানকে দিয়ে সুলতান আলা-উদ-দীন হোসাইন শাহের সময়ে নির্মাণাধীন কুশুম্বা মসজিদের নির্মাণকাজ শেষ করান, পরে হোসাইন শাহের নামাঙ্কিত প্রস্তর ফলকটি অপসারণ না করে তা কেন্দ্রীয় দরোজার ওপর লাগানো প্রস্তর লিপিটি প্রতিস্থাপনও করান। এতে প্রমাণিত হয় যে, কুশুম্বা মসজিদটির নির্মাণকাজ সুলতান আলা-উদ-দীন হোসাইন শাহের শাসন আমলে ১৫০৪ খ্রিষ্টাব্দে (হিজরি ৯১০ সালে) শুরু হয়েছিল। পরে তা পাঠান সুলতান গিয়াস উদ-দীন বাহাদুর শাহ বা খিজির খান ১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দে (৯৬৬ হিজরিতে) নির্মাণকাজ শেষ করেন। ১৩০৪ সালের ভূমিকম্পে মসজিদের ছাদ ভেঙে গেলে এর নির্মাণ কৌশল জানা ও বোঝা যায়। মসজিদের ভেতরে মেহরাবের ওপরে আরবি অক্ষরে ক্ষুদ্র একটি শিলালিপিতে মসজিদেরর নির্মাণকাল ৯১০ হিজরি উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া এ শিলালিপিতে একটি কলেমা উৎকীর্ণ রয়েছে। লিপির একটি পঙ্ক্তিতে হোসেন শাহ রাজত্বের কল্যাণ ও মঙ্গল কামনা করা হয়েছে।
কুশুম্বা প্রাচীনকালের একটি স্থানের নাম। মহাভারতে এটির নাম পাওয়া যায়। পাল রাজা রামপালের সভাকবি সন্ধ্যাকর নন্দী তার ‘রাম চরিতম’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, কুশুম্বা গ্রামটি সামন্ত রাজা দ্বোরপ বর্ধনের রাজধানী ছিল। কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেছেন, গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহের ছেলে নাসির উদ-দীন নুসরত শাহের নির্দেশে এ মসজিদটি নির্মিত হয়েছে।
কিভাবে যাওয়া যায়:
নওগাঁ হতে রাজশাহী মহাসড়কের মান্দা ব্রিজ থেকে পশ্চিম দিকে কুশুম্বা নামক স্থানের ৪০০ মিটার উত্তরে ঐতিহাসিক কুশুম্বা শাহী মসজিদ ও কুশুম্বা দিঘি অবস্থিত।