উত্তরা গণভবন| ট্র্যাভেল নিউজ বাংলাদেশ

879

মৌর্য,সেন,পাল, মোঘল বংশের রাজাদের রাজত্বের স্মৃতি বিজরীত রাজশাহী জেলা। বাংলার অতি প্রাচীন জনপথ গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি জনপথ এই রাজশাহী। রাজশাহী বিভাগের নাটোর জেলা অন্যতম একটি প্রাচীন জনপদ। নাটোরে রয়েছে প্রাচীন স্থাপত্যকলার এক অনন্য নিদর্শন উত্তরা গণভবন। ৩০০ বছরের বেশি আগে নির্মিত এ ভবন আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জেলা শহর থেকে দুই কিলোমিটার উত্তরে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের পাশে উত্তরা গণভবনের অবস্থান। সুদৃশ্য বিশাল সিংহদুয়ার। এর ওপর বিশাল এক ঘড়ি ঘণ্টাধ্বনি বাজিয়ে সঠিক সময় জানান দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া চারদিকে উঁচু প্রাচীর, পরিখার বেষ্টনী, দেশি-বিদেশি বৃক্ষরাজি ও ইটালিয়ান গার্ডেনের শ্বেত পাথরের ভাস্কর্যশোভিত দৃষ্টিনন্দিত এ রাজপ্রাসাদ।

জানা যায়, দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নাটোরের রাজা রামজীবন ও রাণী ভবানীর বিশ্বস্ত দেওয়ান দয়ারাম রায়। ১৭০৬ সালে রামজীবনের কাছ থেকে দয়ারাম রায় নাটোরের দিঘাপতিয়া এলাকায় জমিদারি লাভ করেন। এরপর দুইশ’ বছরের অধিক সময় ধরে বগুড়া, পাবনা, জামালপুর ও যশোর জেলার অংশবিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে শাসন করেছে এই রাজবংশ।

জেলা সদর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তরে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের পাশে রাজা দয়ারাম রায় দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। প্রাচীরের বাইরের ফটকের সম্মুখে রয়েছে ২.৮৯ একর জমি।

এই রাজবংশে ষষ্ঠ রাজা প্রমদানাথ রায়ের সময় ১৮৯৭ সালের জুন মাসে তিনদিনব্যাপী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশন নাটোরের ডোমপাড়া মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এ অধিবেশনে যোগ দেন। কিন্তু অধিবেশনের শেষ দিন ১২ জুন ১৮ মিনিটব্যাপী প্রলয়ঙ্করী এক ভূমিকম্পে রাজপ্রাসাদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

পরে ১৮৯৭ থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত ১১ বছরের চেষ্টায় বিদেশি প্রকৌশলী ও চিত্রশিল্পীদের সহায়তায় ৪১.৫০ একর জমির  ওপর মোঘল ও পাশ্চাত্য রীতি অনুসারে নান্দনিক কারুকার্যময় রাজপ্রাসাদটি পুনর্নির্মাণ করেন প্রমদানাথ রায়।

দৃষ্টিনন্দন প্রবেশদ্বার ছাড়াও এখানে রয়েছে মোট ১২টি ভবন। এগুলোর মধ্যে প্রধান প্রাসাদ ভবন, কুমার প্যালেস, প্রধান কাচারীভবন, রাণীমহল, রান্নাঘর, মোটর গ্যারেজ, ড্রাইভার কোয়ার্টার, ট্রেজারি বিল্ডিং ও সেন্ট্রি বক্স উল্লেখযোগ্য।

রাজপ্রাসাদের দক্ষিণে রয়েছে ফুলের বাগান। এ বাগানটি ইটালিয়ান গার্ডেন নামে পরিচিত। দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুলে পরিপূর্ণ এ বাগান। বাগানের ভেতর শ্বেত পাথরের আকর্ষণীয় চারটি নারীর ভাস্কর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। রয়েছে একটি ইটালিয়ান টাইপের ফোয়ারা এবং লৌহ ও কাঠ দ্বারা নির্মিত বেঞ্চ। এছাড়া রয়েছে একটি ডিম্বাকার সাইজের মার্বেল পাথরের নির্মিত আসনসহ মঞ্চ। সমগ্র বাগানে অসংখ্য ফুলের সমাহার। আছে নাগালিঙ্গম, কর্পুর, এগপ্লান্ট ও হৈমন্তীর মতো দুষ্প্রাপ্র সব বৃক্ষরাজি আর কৃত্রিম ঝর্ণা।

দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির মূল প্রাসাদটি একতলা। এর মধ্যে রয়েছে প্রশস্ত একটি হলরুম। বেশ উঁচু হলরুমের শীর্ষে রয়েছে বিশাল এক গম্বুজ। এ গম্বুজের নিচ দিয়ে আলো-বাতাস প্রবেশ করে। হলরুমের মধ্যে রাজার আমলের তৈরি বেশ কিছু সোফা রয়েছে। এছাড়াও হলরুমে একটি ব্যতিক্রমী কারুকার্য খচিত সোফা রয়েছে। যাতে একসঙ্গে চারজন চারমুখী হয়ে বসা যায়। হলরুমের আসবাবপত্র এখনও রয়েছে। ছাদে রয়েছে সেই আমলের ঝাড়বাতি। হলরুমের পাশে রয়েছে আরেকটি বড় ঘর। পাশের রান্নাঘর হতে এ ঘরে সরাসরি আসা যায়। নিরাপত্তার জন্য রান্নাঘরের করিডোরের দুপাশ রাজ আমলের তার দিয়ে এখনও ঘেরা রয়েছে। এর পাশে একটি ঘরে রয়েছে সিংহাসন। এর পাশের ঘরটি ছিল রাজার শয়নঘর। এ ঘরে এখনও রাজার খাট শোভা পাচ্ছে।

কুমার ভবনের পেছনের ভবন রাজার কোষাগার আর অস্ত্রাগার। দক্ষিণে ছিল রাণীমহল। আজ আর সেটা নেই। ১৯৬৭ সালে ভেঙে ফেলা হয়েছে। রাণীমহলের সামনে একটি ফোয়ারা এখনও সেই স্মৃতি বহন করে চলেছে।  রাজার একটি চিড়িয়াখানাও ছিল।

নাটোরের বর্তমান জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন আবার নতুন করে সেই চিড়িয়াখানা চালু করেছেন। শাহিনা খাতুনের উদ্যোগে রাজার ট্রেজারি ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে সংগ্রহশালা। রাজা-রানীর ব্যবহৃত নানা সামগ্রী সংগ্রহ করে দর্শনার্থীদের দেখার জন্যে এই সংগ্রহশালায় রাখা হয়েছে। মূল ভবন রাজপ্রাসাদের সামনে রয়েছে রাজা প্রসন্ন নাথ রায়ের আবক্ষ মূর্তি। এর দুপাশে রয়েছে দুটি কামান। রাজপ্রসাদের সামনে পূর্বে রয়েছে রাজার দোলমঞ্চ। পাশেই রয়েছে কুমার প্যালেস। এর সামনে বসানো চারচাকা বিশিষ্ট একটি কালো কামান আজও শোভা পাচ্ছে।  রাজপ্রাসাদের প্রবেশের পথে সিঁড়ির দুপাশে ছিল দুটি কালো কৃষ্ণমূর্তি-যা এখন শোভাবর্ধন করছে সংগ্রহশালার। সংগ্রহশালার প্রবেশ করিডরে রয়েছে ধাতব বর্ম। এটা পরেই নাকি রাজা যুদ্ধে যেতেন। এ কারণে পিতলের তৈরি এ বর্মটি দর্শনার্থীদের আরও বিশেষভাবে নজর কাড়ে। রাজপ্রাসাদের উত্তর পাশে ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র। সেখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতে অষ্টাদশ শতকের রাজবাড়ি আলোতে ঝলমল করতো। পুরো রাজপ্রাসাদে ছিল রাজার বিভিন্ন চিত্রকর্ম, ছবি আর বিদেশি ঘড়ি। আজ সেসব আর নেই। প্রাসাদের শ্বেতপাথরের মেঝে মোড়ানো থাকতো পার্সিয়ান গালিচায়। রাজা প্রমদানাথ রায়ের ঘড়ি প্রীতি ছিল। আর এজন্য তিনি দেশ বিদেশ থেকে অর্ডার দিয়ে ঘড়ি তৈরি করে আনতেন। এসব ঘড়ি  রাজপ্রাসাদ ছাড়াও বিভিন্ন ভবনে স্থাপন করেছিলেন। এমন একটি ঘড়ি ছিল যাতে ১৫ মিনিট পরপর জলতরঙ্গ বাজতো। এছাড়া রাজবাড়ির মূল ফটকে রয়েছে একটি ঘড়ি। এর দুপাশে দুটি ডায়াল। ঘড়িটি এখনও সঠিকভাবেই সময় দিয়ে যাচ্ছে। ঘড়িটি ইটালির ফ্লোরেন্স থেকে আনা হয়েছিল। আগে এর ঘণ্টাধ্বনি ১০-১২ মাইল দূর থেকে শোনা যেত। এখন এই ঘণ্টাধ্বনি শোনা যায় প্রায় এক মাইল দূর থেকে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দিঘাপতিয়া রাজবাড়িতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প হওয়ায় কিছু ঘড়িসহ অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ লুট হয়।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দিঘাপতিয়া রাজা দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি এটাকে উত্তরা গণভবন হিসেবে এবং নাটোরকে দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেন। ২০০৮ সালে দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে এর বেশির ভাগ অংশ। উত্তরা গণভবনের দর্শনার্থীদের নিরাপত্তায় টুরিস্ট পুলিশের একটি টিমও  কাজ করছে।

যেভাবে যাবেনঃ-

ঢাকা থেকে সরাসরি বাস কিংবা ট্রেইনে চেপে সরাসরি নাটোর জেলা শহরে পৌঁছানো যায়। ঢাকার গাবতলি,সায়দাবাদ,মহাখালি বাস টার্মিনাল গুলো থেকে বাস পাওয়া যায়।কমলাপুর স্টেশন থেকে ট্রেইন যাত্রা শুরু হয়। নাটোর জেলা সদর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তরে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের পাশে অবস্থিত। জেলা সদর থেকে রিক্সা যোগে উত্তরা গণভবন পৌঁছানো যায়।