প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। মৌলভীবাজার ফরেস্ট রেঞ্জের আওতাধীন শ্রীমঙ্গলের এই ন্যাশনাল পার্ক শুধু যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য শুধু তাই নয়, দেশের সবকটি বনাঞ্চলের মধ্যে সব চেয়ে নান্দনিক ও আকর্ষনীয়। ১২৫০ হেক্টর আয়তনের এই বন জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে এই বনকে ‘জাতীয় উদ্যান’ হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশের সাতটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও দশটি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে লাউয়াছড়া অন্যতম। চিরহরিৎ এ বনাঞ্চল বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের নিরাপদ আবাসস্থল। এছাড়াও নানান দুর্লভ জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ আর গাছপালার জন্য এ অরণ্য বিখ্যাত।
লাউয়াছড়া যাবার পথে চোখে পড়বে চোখ জুড়ানো চা বাগান, পাহাড়, বন বনানী, উঁচু-নিচু টিলা শ্রেণী, আনারস, লিচু ও লেবু বাগান। স্থানীয় চা শ্রমিকদের ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘর। পাখ-পাখালির কূজন, আর চারিদিকে সবুজের ছড়াছড়ি যেন সবুজ একটি স্বর্গ রাজ্য। লাউয়াছড়ায় প্রবেশ করা মাত্রই শুনতে পাওয়া যাবে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। গাছে গাছে পাখিদের কিচির-মিচির। মূল রাস্তার দু-ধারে বিশাল-বিশাল বনজ বৃক্ষের বহর দেখলে মনে হয় প্রকৃতি যেন তার নিকট যাবার পথটা তৈরি করে রেখেছে আমাদের জন্য।
জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে লাউয়াছড়ার জাতীয় উদ্যান বাংলাদেশের সমৃদ্ধতম বনগুলোর একটি। আয়তনে ছোট হলেও এ বন দুর্লভ উদ্ভিদ এবং প্রানীর এক জীবন্ত সংগ্রহশালা। বনে প্রবেশের সাথে সাথেই নানা ধরনের বন্যপ্রাণী, পাখি এবং কীটপতঙ্গের শব্দ শোনা যায়। বনের মধ্যে প্রায় সারাক্ষণই সাইরেনের মত শব্দ হতে থাকে; প্রকৃতপক্ষে এটি এক ধরণের ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। লাউছড়ার জাতীয় উদ্যানে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রানী দেখা যায়।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে আছে অজগরসহ নানারকম সাপ। এছাড়া হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপও এ বনের উল্লেখযোগ্য সরীসৃপ। পাখিদের মধ্যে আছে— সবুজ ঘুঘু, বনমোরগ, হরিয়াল, তুর্কিবাজ, কালো মাথা টিয়া, লেজকাটা টিয়া, কালো ফর্কটেইল, ধুসর সাতশৈলী, কালো বাজ, হিরামন, কালো মাথা বুলবুল, ধুমকল, পেঁচা, ফিঙ্গে, সবুজ সুইচোরা, সবুজ কোকিল, পাঙ্গা, কেশরাজ ইত্যাদি। বিলুপ্তপ্রায় উল্লুক (Hoolock Gibbon) এর জন্য এ বন বিখ্যাত। বনের মধ্যে কিছু সময় কাটালেই উল্লুকের ডাকাডাকি কানে আসবে। উল্লুক ছাড়াও এখানে রয়েছে মুখপোড়া হনুমান, বানর, শিয়াল, মেছোবাঘ, বন্য কুকুর, ভাল্লুক, মায়া হরিণ (বার্কিং ডিয়ার),অজগরসহ নানা প্রজাতির জীবজন্তু। মায়া হরিণ সাধারণত উচ্চতায় ২০-২২ ইঞ্চি। এদের বাদামী রঙের দেহ যা পিঠের দিকে ঘিয়ে গাঢ় রং ধারণ করে। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে মাইকেল অ্যান্ডারসন নির্দেশিত হলিউডের বিখ্যাত চলচ্চিত্র অ্যারাউন্ড দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ (Around the World in 80 Days)-এর কিছু দৃশ্য ধারণ করা হয়েছিলো লাউয়াছড়ার এই জাতীয় উদ্যানে।
নৈসর্গ প্রকল্পের আওতায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রকৃতি ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নির্দিষ্ট হারে প্রবেশ মূল্য দিয়ে এ বনের ভেতর প্রকৃতি ভ্রমণ করা যায়। প্রকৃতি ভ্রমণের জন্য বনে তিনটি ট্রেইল বা হাঁটা পথ রয়েছে। তিনটি পথের মধ্যে একটি ৩ ঘণ্টার পথ, একটি ১ ঘণ্টার পথ আর অপরটি ৩০ মিনিটের পথ। প্রশিক্ষিত গাইডের সহায়তায় বনের একেবারে ভেতর পর্যন্ত যাওয়া যায়। প্রকৃতিকে বিরক্ত না করে তৈরি করা এ তিনটি পথে চোখে পড়বে নানা প্রজাতির কীটপতঙ্গ, গাছপালা, পাখি ও অর্কিড। ভাগ্য ভালো হলে হনুমান, বানর এবং উল্লুকেরও দেখা মিলতে পারে। দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক প্রতিদিন লাউয়াছড়ায় প্রকৃতি ভ্রমণে আসেন। বছরজুড়েই এই বনে পর্যটকদের আনাগোনা থাকলেও শীতের সময় সবচেয়ে বেশি লোকসমাগম হয়।
যেভাবে যাবেন:-
ঢাকা থেকে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে যেতে ট্রেন হচ্ছে সবচেয়ে ভালো মাধ্যম। ঢাকা থেকে ট্রেনে করে শ্রীমঙ্গল যেতে কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশান হতে উপবন, জয়ন্তিকা, পারাবত অথবা কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনকে বেছে নিতে পারেন আপনার ভ্রমণ সঙ্গী হিসাবে। শ্রেণিভেদে জনপ্রতি ট্রেনে যেতে ভাড়া ২৬৫ থেকে ১০০০ টাকা। ট্রেনে যেতে সময় লাগে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা। বাসে করে ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল যেতে ফকিরাপুল অথবা সায়েদাবাদ থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা ভাড়ায় হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, সিলেট এক্সপ্রেস, এনা ইত্যাদি নন এসি বাস পাওয়া যায়। বাসে যেতে সময় লাগে ৪ ঘণ্টার মতো। শ্রীমঙ্গল পৌঁছে সেখান থেকে আপনার চাহিদা অনুযায়ী কোনো গাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন লাউয়াছড়া উদ্যানে। ইজিবাইক/সিএনজি/জিপ/মাইক্রোবাস যেকোনো কিছুতেই যাওয়া যায়। যাওয়া-আসা ও সেখানে ঘুরে বেড়ানোর সময়সহ রিজার্ভ নিলে সিএনজি ৪০০-৫০০ টাকা নিবে।