বৃহত্তর নোয়াখালীর ফেনী জেলার প্রাণ কেন্দ্র ট্রাঙ্ক রোডের পাশেই তাকিয়া বাড়িতে রয়েছে প্রখ্যাত ‘পাগলা মিয়ার’ মাজার। ফেনী অঞ্চল ও এর আশে পাশের সকল ধর্মের মানুষের কাছে এটি এক পরম তীর্থ কেন্দ্র।
পাগলা মিয়ার প্রকৃত নাম হযরত শাহ সৈয়দ আমির উদ্দিন ওরফে পাগলা মিয়া। তবে তিনি তাঁর আসল নামের আড়ালে পাগলা মিয়া নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি একাধারে ছিলেন পাগল, আধ্যাত্বিক সাধক এবং সকল ধর্মের সকল জাতের ঊর্ধ্বে এক মহামানবতার প্রতীক।এ মহান পাগল সাধকের আদি নিবাস ছিলো বাগদাদ। তাঁর পিতা ছিলেন সৈয়দ বশির উদ্দিন এবং মাতার নাম সৈয়াদা মায়মুনা খাতুন। পাগলা মিয়া ছিলেন তাঁর পিতা মাতার একমাত্র সন্তান।বাংলা ১২৩০ সালে এই সাধক পুরুষ ফেনীতে জন্ম গ্রহন করেন।
শিশুকাল থেকেই এই সাধকের মধ্যে নানা রকম্ পাগলামীর ভাব পরিলক্ষিত হয়।তাঁর বয়স যখন চার বৎসর তখন তাঁর পিতা মাতা চট্টগ্রামের একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। সে সময় থেকে তিনি পড়া শুনার প্রতি খুব মনোযোগী ছিলেন এবং সব সময় সাদা কাপড় পরতেন এবং নিরিবিলি থাকতে পছন্দ কতেন। মাদ্রাসার নিয়ম শৃঙ্খলায় আদব কায়দাতে তাঁর খুব সুনাম ছিলো। তাঁর বয়াস যখান বার বছর তখন তিনি বাড়িতে তাঁর মায়ের কাছে আসেন। বাড়িতে এসে তাঁর বাড়ির আঙিনায় একটি আমগাছের চারদিকে কাপড়ের ঘেরা দিয়ে নিরিবিলি ধ্যানে মগ্ন হয়ে রইলেন।এ সময় তিনি খাওয়া দাওয়া ভুলে সকল সংগ ত্যাগ করে রইলেন। বেশ কয়দিন এভাবে যাওয়ার পর তাঁর স্নেহময়ী মাতা আস্থির হয়ে উঠলেন। ছেলের এ আবস্থা দেখে তিনি বিলাপ করে কাঁদতে লাগলেন আর পাগল ছেলেকে সেখান থেকে উঠে আসতে বললেন। মায়ের এ অবস্থায় তিনি সহ্য করতে না পেরে সেখান থেকে বের হয়ে আরো বেশী পাগলের মত লোকজনকে গালালাগালি করতে লাগলেন। সে সময় নিকটবর্তী পাহাড়ে রাখাল ছেলেদের ও চাষীদেরকে বকাবকি শুরু করেন। তখন তাঁর মস্তিষ্ক বিকৃত হয়েছে এই ধারনায় তার প্রতিবেশী ও পার্শবর্তী লোকজন তাঁকে ‘মিরেরগো পাগল, মীরেরগো পাগল’ বলে ডাকতে লাগলো। সেই থেকে তিনি মীরেরগো পাগল বলে পরিচিত হলেন। আর একের পর এক পাগলামী কর্মকান্ড করে চল্লেন। কিন্তু তাঁর সেই পাগলামোর মধ্যে ছিলো গভীর আধ্যাত্বিকতা ও গূড় রহস্য। সে পাগলামো কেউ তাৎক্ষণিক না বুঝতে পারলেও পরবর্তী কালে মানুষ তা দৃঢ়ভাবে অনুভব করতে থাকে। তখন ছিলো চৈত্র মাস। পাগলা এসে তাঁর মাকে মাছ ধরার ‘চাই’ দিতে বল্লেন। মা বুঝতে পারলেন না মাঠ ঘাট শুকিয়ে চৌচির হয়ে আছে পাগলা মাছ পাবে কোথায়। তবু মা ‘চাই’ বের করে দিলো।পাগলা বললেন, ‘মা, তোমাকে ইঁচা মাছ খাওয়াবো’ এই বলে একটি চৌদ্দহাত গাছের উপরে চাইটি বেঁধে রাখলো। লোকজন তার পাগলামী দেখে হাসাহাসি করতে থাকে। এর কয়দিন পর এসে তার মাকে আবার বললো, ‘মা ঘরের চালে উঠ, নাহলে বাঁচবানা’। তখন হঠাৎ করে দেশে বিরাট বন্যা শুরু হোলো। তখন এতই পানি হলো যে, পাগলা গাছে যে মাছ ধরার চাই বেঁধে ছিলো সে চাইও ডুবে গেলো। সে বছর যে বন্যা হয়েছে তা ছিলো এক অভাবনীয় বন্যা। চৈত্র মাসে সাধারনতঃ কোনো বন্যা হয়না। কিন্তু এই পাগলের আধ্যাত্বিক ক্ষমতা বলে তিনি তা আগে ভাগেই পূর্বাভাষ পেয়েছিলেন।পানি নেমে গেলে পাগলা গাছ থেকে চাই নামিয়ে আনলো। আর সবাই দেখলো ‘ইঁচা’ মাছে চাই ভরে আছে। ধীরে ধীরে এই মহান পাগল সাধকের নানান আধ্যাত্বিক ক্ষমতার কথা লোকমুখে প্রচার হতে থাকে। তিনি হয়ে উঠেন ফেনীর উজ্জল রবি আধ্যাত্বিক সাধক হযরত শাহ্ সৈয়দ আমির উদ্দিন পাগলা মিঞা (র)।
এই মহান সাধক ১২০৯৩ বাংলা সনের ১৩ই শ্রাবণ রোজ বুধবার ফেনীর তাকিয়া বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। ওফাতের পরে তাঁকে সেই স্থানেই সমাহিত করা হয়। তাঁর এই সমাধী স্থান ঘিরেই তাঁর মাজার শরীফ বিদ্যমান রয়েছে।
প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের প্রথম বৃহষ্পতিবার ও শুক্রবার তাকিয়া বাড়িতে পাগলা মিয়ার ওরছ শরীফ অনুষ্টিত হয়।
কিভাবে যাবেন:-
ফেনী জিরো পয়েন্ট থেকে খুব কাছে শহরের টাকিয়া পয়েন্টে এই মাজারটি অবস্থিত। আপনি এখানে পায়ে হেঁটে চারপাশ দেখতে দেখতে আসতে পারেন অথবা রিকশায় করেও মাজারের কাছাকাছি আসতে পারেন। স্থানীয়রা এই জায়গাটিকে টাকিয়া মসজিদ নামে চেনে। এই মাজারের প্রধান আকর্ষণ হলো এটির নকশার কারুকাজ সম্পন্ন গম্বুজ।