জিনজিরা প্রাসাদ একটি ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি, যার অবস্থান ঢাকা শহরের বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কয়েক’শ গজ দূরে। সোয়ারীঘাট সংলগ্ন বড় কাটরা প্রাসাদ বরাবর বুড়িগঙ্গন, ওপারে জিনজিরা। জিনজিরা-জাজিরার অপভ্রংশ, যার অর্থ আইল্যান্ড বা দ্বীপ। এ দ্বীপে ১৬২০-২১ খ্রিস্টাব্দে জিনজিরা প্রাসাদ ‘নওঘরা’ নির্মাণ করেছিলেন তৎকালীন সুবেদার নওয়াব ইব্রাহিম খাঁ। দ্বিতীয় ইবরাহিম খান তাঁর প্রমোদকেন্দ্র হিসেবে প্রাসাদটি নির্মাণ করেন।
আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে শহর থেকে জিনজিরার মধ্যে চলাচলের জন্য একটি কাঠের পুল ছিল। পলাশীর যুদ্ধে সর্বস্বান্ত সিরাজদ্দৌলার পরিবার পরিজনকে জরাজীর্ণ জিনজিরা প্রাসাদে প্রেরণ করা হয়েছিল। আর সেই সাথে নবাব আলিবর্দী খাঁর দুই কন্যা¬ঘসেটি বেগম ও আমেনা বেগমকেও আনা হয়। তারা দু’জনই পিতার রাজত্বকালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। অবশেষে এক দিন পরিচারিকাদের সাথে একই নৌকায় তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। সে দিন বুড়িগঙ্গার তীরের জিনজিরা প্রাসাদে বন্দীদের নিয়ে রক্ষীদল উপস্খিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, নবাব আলিবর্দী খাঁ ও তার পরিবার আগেই এখানে স্থান লাভ করেছিল। এভাবে পরাজিত নবাবের পরিবার-পরিজন জিনজিরা প্রাসাদে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তার পর মীরজাফরের পুত্র মীরনের চক্রান্তে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মের কোনো এক সন্ধ্যায় সিরাজ পরিবার জিনজিরা প্রাসাদ থেকে নেমে বুড়িগঙ্গা নদীর বুকে এক নৌকায় আরোহণ করে। নৌকা যখন বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীর সঙ্গমমূলে ঢাকাকে পেছনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন মীরননিযুক্ত ঘাতক বাকির খান নৌকার ছিদ্রস্থান খুলে দিয়ে নৌকাটি ডুবিয়ে দেয়।কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবাই তলিয়ে যান বুড়িগঙ্গায়।
দেখার জন্য রয়েছে পশ্চিমাংশে দু’টি সমান্তরাল গম্বুজ, মাঝ বরাবর ঢাকনাবিহীন অন্য একটি গম্বুজ ও পূর্বাংশ দোচালা কুঁড়েঘরের আদলে পুরো প্রাসাদের ছাদ। প্রাসাদের পূর্বাংশে ছাদ থেকে একটি সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। স্থানীয়রা এ প্রাসাদকে হাবেলী নগেরা বা হাওলি নগেরা বলে। এ প্রাসাদের তিনটি বিশেষ অংশ আজো আংশিক টিকে আছে¬ তাহলো¬ প্রবেশ তোরণ, পৃথক দু’টি স্থানে দু’টি পৃথক প্রাসাদ, একটি দেখতে ফাঁসির মঞ্চ ও অজ্ঞাত অন্যটি প্রমোদাগার।কয়েক একর জমির ওপর এ প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছিল অবকাশ যাপন ও চিত্তবিনোদনের প্রান্তনিবাস হিসেবে। চার দিকে সুনীল জলরাশির মাঝখানে একখণ্ড দ্বীপ ভূমি জিনজিরা। নারিকেল-সুপারি, আম-কাঁঠালসহ দেশীয় গাছগাছালির সবুজের সমারোহে ফুলে ফুলে শোভিত অপূর্ব কারুকার্যখচিত মোগল স্থাপত্যশৈলীর অনুপম নিদর্শন জিনজিরা প্রাসাদ।স্থানীয়দের মতে মোগল আমলে লালবাগ দুর্গের সঙ্গে জিঞ্জিরা প্রাসাদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য বুড়িগঙ্গার তলদেশ দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করা হয়েছিল। এপথে মোগল সেনাপতি ও কর্মকর্তারা আসা-যাওয়া করত। লালবাগ দুর্গেও এমন একটি সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
কীভাবে যাবেন:
জিনজিরা প্রাসাদ একটি ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি যা বাংলাদেশের ঢাকা শহরের বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে কয়েকশ’ গজ দূরে অবস্থান। দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে সড়ক পথে প্রথমে রাজধানীতে আসতে হবে। গাবতলী কিংবা সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে নেমে সদরঘাটগামী বাসে উঠতে হবে। সদরঘাটে যাওয়ার পর নৌকা কিংবা ট্রলারে চেপে বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে ওপারে গেলেই দেখা পাবেন জিনজিরা প্রাসাদের। ট্রেন যোগে আসলেও রাজধানীর কমলাপুর ট্রেন স্টেশন থেকে একই উপায় অবলম্বন করতে হবে। আর যারা নদীপথে ঢাকায় আসেন তাদের জন্য সবচেয়ে সহজ জিনজিরা প্রাসাদে যাওয়া। লঞ্চ থেকে সদরঘাটে নেমেই নদীর ওপারে জিনজিরা প্রাসাদ। বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে সোয়ারীঘাট সংলগ্ন বড় কাটরায় গিয়ে খোঁজ করলেই নির্দেশনা পাওয়া যাবে। রাজধানীতে যারা থাকেন তারা ছুটির দিনে পরিবার পরিজনসহ ঘুরে আসতে পারেন বাংলার ইতিহাসের অন্যতম স্মৃতিবিজড়িত স্থান জিনজিরা প্রাসাদ থেকে। নদীপথে যেতে এডভেঞ্চারও হবে আবার স্বচক্ষে দেখার সুযোগও হবে এ ঐতিহাসিক স্থানটি।