“মেঘের দেশ সাজেক” ভ্রমণের স্মৃতিকথা

1210

“মেঘের দেশ সাজেক” ভ্রমণের স্মৃতিকথা

মেঘের দেশ সাজেক রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলাধীন সাজেক ইউনিয়নের একটি প্রধান পর্যটন কেন্দ্র৷এটি রাঙ্গামাটি জেলার সর্বউত্তরের আর ভারতের দক্ষিণ পশ্চিমের সীমান্ত ঘেষে অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর একটি উঁচু উপত্যকা ৷যার ভিতর দিয়ে লুসাই নদী প্রবাহিত৷ সাজেকের উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য আর পূর্বে ভারতের মিজোরাম রাজ্য৷ বর্তমানে পর্যটকদের কাছে অন্যতম জনপ্রিয় ভ্রমণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই সাজেক ভ্যালি ৷

মেঘের দেশ সাজেকে গিয়েছিলাম চার বছর আগে৷ সময়টি ছিল ২০১৫ইং সালের অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহ ৷ কুরবানীর ঈদের সপ্তাহ খানেক পর, ট্যুর এ যাওয়া হবে পাহাড়ী দেশে৷ সুযোগ হাতছাড়া করলাম না৷ তখন পড়তাম ঢাকার সরকারি বিজ্ঞান কলেজে ৷ থাকতাম ফার্মগেটের পূর্ব রাজা বাজার একটি মেসে৷

আমাদের ট্যুরটি ছিল রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায়৷ আমরা ছিলাম প্রায় আশিজন৷ ঢাবি, বুয়েট আর সরকারী বিজ্ঞান কলেজের ছাত্র ছিলাম সবাই ৷ অক্টোবরের এক তারিখ রাত দশটায় শ্যামলী পরিবহনের দুটি বাসে করে রওয়ানা হলাম৷ পরেরদিন সকালে ৭টার দিকে আমরা পৌঁছাই খাগড়াছড়ি শহরে৷ সকালের নাস্তা সেরে উঠলাম চাঁদের গাড়িতে (কেউবা বলে চান্দের গাড়ি) ৷ প্রথমদিনের লক্ষ্য ছিল বিকালের মধ্যে সাজেক পৌঁছানো ৷

মেঘের দেশ সাজেক রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত হলেও রাঙ্গামাটি শহর থেকে দুরত্ব প্রায় ১৩০কিমি আর খাগড়াছড়ি থেকে প্রায় ৭০ কিমি ৷ তাই সাজেক যেতে হলে খাগড়াছড়ি শহর থেকে যাওয়া সবচেয়ে সুবিধাজনক ৷ যাইহোক, এই ৭০কিমি এর মধ্যবর্তী স্থান বাঘাইছড়ি ৷ শহর থেকে ৩৫কিমি , আর বাঘাইছড়ি থেকে সাজেক ৩৫কিমি (সেনাবাহিনীর অধীনে নির্মিত)৷ বাস বা পরিবহণে করে দীঘিনালা পর্যন্ত সরাসরি যাওয়া যায় এবং দীঘিনালা থেকে সাজেকের দূরত্ব প্রায় ৪৯ কিলোমিটার । আর রাঙামাটি থেকে নৌপথে কাপ্তাই হয়ে এসে অনেক পথ হেঁটে সাজেক যাওয়া যায় । সাজেক রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত হলেও এর যাতায়াত সুবিধা খাগড়াছড়ি থেকে৷ খাগড়াছড়ি শহর অথবা দীঘিনালা হতে স্থানীয় গাড়িতে ( জিপ গাড়ি , সি.এন.জি , মটরসাইকেল ) করে সাজেকে যাওয়াই হচ্ছে বর্তমানে সবচেয়ে সহজ ও জনপ্রিয় মাধ্যম । এক্ষেত্রে পথে পড়বে বাঘাইহাট পুলিশ ও আর্মি ক্যাম্প। সেখান থেকে ভ্রমণরত সদস্যদের তথ্য দিয়ে সাজেক যাবার মূল অনুমতি নিতে হবে । একে আর্মি এসকর্ট বলা হয় । আর্মিগণের পক্ষ থেকে গাড়িবহর দ্বারা পর্যটকদের গাড়িগুলোকে নিরাপত্তার সাথে সাজেক পৌঁছে দেয়া হয় । দিনের দুইটি নির্দিষ্ট সময় (সকাল ১০:৩০ এবং বিকাল ৩:৩০) ব্যতীত আর্মি ক্যাম্পের পক্ষ হতে সাজেক যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয় না । পর্যটকদের সর্বাধিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই এই নিয়ম অনুসরণ করা হয় । সাজেকগামী জিপ গাড়িগুলো স্থানীয়ভাবে চান্দের গাড়ি নামে পরিচিত । সাজেক যাওয়ার পথে বাঘাইহাটে হাজাছড়া ঝর্ণা অবস্থিত । অনেক পর্যটকগণ মূল রাস্তা হতে সামান্য ট্রেকিং করে গিয়ে ঝর্ণাটির সৌন্দর্য উপভোগ করে থাকেন ৷

সাজেকগামী উঁচুনিচু পাহাড়ের বুক চিড়ে এই আঁকাবাঁকা রাস্তাগুলি ঠাঁই করে নিয়েছে৷ পথে পড়বে তিনটি ঝর্ণা আর আলুটিলার গুহা ৷ আমরা হাজাছড়া ঝর্ণা, রিসাং ঝর্ণা ও দ্বৈতছড়া ঝর্ণাগুলিতে গেলাম৷ দ্বৈতছড়া ঝর্ণার পথটা অনেক সরু আর পথে একটি বিশাল বটবৃক্ষ পড়বে৷এসবগূলি দেখতে দেখতে এগোতে থাকলাম সাজেক ভ্যালীর দিকে ৷ আমরা সাজেক পৌঁছাই দুই অক্টোবর বিকাল চারটায়৷ দুপুরের খাবারের কথা না বললেই নয় , উপজাতিদের রেস্তোরা ৷ ছিল ভাতের সাথে মুরগীর মাংস, ডিম ভাজা , ডাউল আর বাশঁ ভাজি(কচি বাশেঁর কোড়ল) ৷ খাবারের মূল্য ১০০—২০০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে৷

রাতে থাকলাম কাঠনির্মিত ঘরে৷ বর্তমানে অনেক আবাসিক হোটেল ও রিসোর্ট নির্মাণ করা হয়েছে৷ আছে সৌন্দর্যমন্ডিত কটেজ৷ উল্লেখযোগ্য রিসোর্টগুলির মধ্যে রয়েছে প্যারাডাইজ সাজেক, মেঘপুন্ঞ্জি রিসোর্ট, রয়েল রিসোর্ট, মেঘ বালিকা রিসোর্ট, মেঘ কাব্য রিসোর্ট, শিন্ঞ্জন রিসোর্ট, সিনারী হোটেল প্রভৃতি৷ আর সেনাবাহিনী পরিচালিত একমাত্র রিসোর্ট রুণময় রিসোর্ট, এখানে থাকতে হলে প্রথম শ্রেণির সরকারি অফিসার কর্তৃক রিকমান্ডেড হয়ে আসতে হয়৷ভাড়া পড়বে রুমপ্রতি ৫০০০ — ৭০০০ টাকা, যেখানে প্রতি রুমে ৪জন থাকা যায় ৷ আর সিঙ্গেল রুমে দুই জন করে থাকা যায়, ভাড়া পড়বে ৩০০০— ৪০০০টাকা ৷ তবে অফ সিজনে ৩০% ছাড় পাওয়া যায়৷সাজেকে প্রধানত লুসাই, পাংখোয়া, ত্রিপুরা আদিবাসীরা বসবাস করে৷এখানকার কলা ও কমলা বিখ্যাত, পাহাড়ে ভ্রমণে এগুলো অত্যাবশ্যকীয় খাবার হিসেবে সুপরিচিত৷সাজেকের আবাসিক রোডের পাশে একটি গির্জা রয়েছে, অধিকাংশ খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী হওয়ায় এখানে নানাবিধ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করা হয়৷বিদ্যুতের সুব্যবস্থা না থাকায় সোলার পদ্ধতিতে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয় ৷ পানির উৎস হিসেবে ঝর্ণাই প্রধান, ঝর্ণা থেকে পানি সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া হয়৷ আর যোগাযোগের জন্য রবি ও টেলিটক মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে হয়, অন্য কোন অপারেটর এখানে নেটওয়ার্ক পায় না৷

পরের দিন সকালে আমি একটূ তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠেছিলাম৷ একাকী হাটতে লাগলাম সাজেক আর্মি ক্যাম্পের দিকে৷ মসজিদে ঢুকলাম ফজর নামাজের আযানের সাথে সাথে৷ এটি রাঙ্গামাটির সর্ব উত্তরের সর্বশেষ আর্মি ক্যাম্প ও মসজিদ ৷ মসজিদে উপস্থিত ছিলেন ইমাম , ক্যাম্প কমান্ডার_ মেজর(মুয়াজ্জিন)৷ অনেক বিষয়ে উনাদের সাথে আলাপ হলো৷ জানালেন পাহাড়ের অনেক ইতিহাস আর পাহাড়ী মানুষদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে৷ আমার কাছে ছিল লাল রঙের গামছা , গলায় ঝুলিয়ে রাখা যেন বঙ্গবীর কাদের সিদ্দীকি বীর উত্তম সাহেবের পার্টির লোক ৷ মেজর সাহেব একখানা টূপি আমার মাথায় পড়িয়ে গামছা দিয়ে পাগড়ী বাধার মত বেধে দিলেন৷ অবশ্য এতক্ষনে অনেক সৈন্য মসজিদে প্রবেশ করেছেন, অতপর জামাতের সহিত নামাজ শেষ করে আবার আলাপ হলো ইমাম আর ক্যাম্পের এক সেনা সদস্যের সাথে৷

সাজেকের অধিকাংশ রিসোর্টগুলো রুইলুই পাড়ায়, এই পাড়ার গোড়াপত্তন হয় ১৮৮৫ সালে৷ অপর পাড়াটি কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় কংলাক পাড়া৷ সকাল সাতটার দিকে সবাই ভ্যালীর হ্যালি প্যাডে এসে পৌঁছালো৷ ভ্যালীর হেলিপ্যাড থেকে নিচের দিকে তাকালে শুধু মেঘই চোখে পড়বে৷ এখানে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত দুটি হ্যালি প্যাড রয়েছে৷ ঘন্টা খানিক পর আমরা রওয়ানা হলাম ক্যাম্প থেকে উত্তর পশ্চিমে প্রায় তিন কিমি দূরে দূর্গম পথ পেরিয়ে কংলাক পাহাড়ের চূড়ায়৷ যার উচ্চতা সমতল থেকে প্রায় ১৮০০ ফুট এবং সাজেক ভ্যালীর রুইলুই পাড়ার উচ্চতা প্রায় ১৭২০ ফুট৷ কংলাক পাহাড়ের পথটা আঁকা বাঁকা রাস্তা হওয়ায় নিশানা হিসেবে লাল নিশানাধারী দুজনকে সামনে থাকার সিদ্ধান্ত হল৷ তার একজন আমার সবিক এর বড়ভাই লাল পান্জাবী পরিহিত পটুয়াখালীর দশমিনার সুবক্তা জনাব মোঃ শরফুদ্দিন ভাই , ঢাবি (ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান), অন্যজন ছিলাম গলায় লালগামছা ঝুলানো আমি৷ মেঠোপথ পেরিয়ে সাজেক ভ্যালি থেকে কংলাক পাহাড়ে যেতে সময় লাগত এক থেকে দেড় ঘন্টা , আর্মিদের লাগত ৪০-৫০মিনিট ৷ বর্তমানে সাজেক ভ্যালী থেকে প্রায় দুই কিমি. রাস্তা পাকা করা হয়েছে ৷ বাকী আরও আধা কিমি. রাস্তা পায়ে হেটে পৌঁছাতে হয় কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় ৷

পাহাড়ের চূড়ান্ত শেষপ্রান্তে পাথরের ভাঁজ বেয়ে উপরে উঠতে হয়৷ সেখানে প্রায় চল্লিশটি পরিবারের শতাধিক মানুষের বাস ছিল৷ বর্তমানে অর্ধ শতাধিক পরিবারের বাস সেখানে৷ কংলাক পাড়ায় তাদের একজন গোত্র প্রধান বা হেডম্যান আছে, যাকে সবাই সম্মান করে এবং সব ক্ষেত্রে তার নির্দেশ মেনে চলে৷ তবে আশ্চর্যের বিষয় মাত্র কয়েক বছর আগে নাকি এটি আবিষ্কার হয়েছে৷ পুরোপুরি সভ্যতা পায়নি, কিছুটা শিখছে আর্মিদের মাধ্যমে৷ আমার নিকট আরও বেশি আশ্চর্যের বিষয় ছিল পাথরে খোদাই করা এক খ্রিস্টান মিশনারীজের কবরের চিহ্ন আর ইটনির্মিত পুরনো একটি প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্রের ধ্বংসস্তুপ! হা ঐ জায়গা থেকে আর একটু দুরে একটি ঘন জঙ্গল, ঐখানকার অধিবাসীরা তখনো সভ্যতার আওতায় আসেনি, ভাষা বোঝেনা , কাউকে দেখলে আক্রমণ করতে আসে ৷ তাই জনসাধারনের যাওয়া বারন৷ আর্মিরা প্রোটেক্টেড হয়ে যান ঐ জঙ্গলে৷

বেলা নয়টার দিকে আমরা ছিলাম কংলাক পাহাড়ের চূড়ায়৷ যেখান থেকে উত্তরে তাকালে মেঘ ছাড়া কিছুই পড়ে না চোখে ৷ নিচের দিকে তাকালে মনে হবে হয়তো সাগর প্রবাহিত হচ্ছে ৷যতদূর চোখ যাবে মনে হবে সাগরের জলরাশি ৷ আসলে এগুলো মেঘপুন্ঞ্জি ৷ সেজন্যই বলা হয় মেঘের দেশ সাজেক৷