প্রাচীন বাংলার গৌড়ের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় সেন বংশের রাজাদের স্মৃতিচিহ্ন ও সুলতানী আমলে নির্মিত মসজিদই এ এলাকার ঐতিহাসিক স্থাপনা। আর এই স্থাপনাগুলোর মধ্যে সুলতানী স্থাপত্যের ছোট সোনামসজিদ অন্যতম।
গৌরের রত্ন’ নামে খ্যাত এই মসজিদটির বাইরের দিকে সোনালী রঙ এর আস্তরণ ছিলো, সূর্যের আলো পড়লে নাকি এ রঙ সোনার মত ঝলমল করত। অন্যদিকে প্রাচীন গৌড়ে আরেকটি মসজিদ ছিলো যা সোনা মসজিদ নামে পরিচিত। এটি তৈরি করেছিলেন সুলতান নুসরত শাহ। সেটি ছিলো আরও বড়। তাই স্থানীয় লোকজন এটিকে ছোটো সোনা মসজিদ এবং গৌড় নগরীর মসজিদটিকে বলতো বড় সোনা মসজিদ বলে অবহিত করতো।
সজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৮২ ফুট লম্বা ও পূর্ব-পশ্চিমে ৫২.৫ ফুট চওড়া। উচ্চতা ২০ ফুট। এর দেয়ালগুলো প্রায় ৬ ফুট পুরু। দেয়ালগুলো ইটের তৈরী কিন্তু মসজিদের ভেতরে ও বাইরে পাথর দিয়ে ঢাকা। মসজিদের চারকোণে রয়েছে চারটি বুরুজ । এগুলোর ভূমি নকশা অষ্টকোণাকার। বুরুজগুলোতে ধাপে ধাপে বলয়ের কাজ আছে। বুরুজগুলোর উচ্চতা ছাদের কার্নিশ পর্যন্ত। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে রয়েছে পাঁচটি মাল্টিফয়েল্ড আর্চড দরজা। আর্চগুলো বহুভাগে বিভক্ত (multiple cusped)এবং বিভিন্ন অলংকরণে সমৃদ্ধ। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে রয়েছে তিনটি করে দরজা। তবে উত্তর দেয়ালের সর্ব-পশ্চিমে ব্যতিক্রম রয়েছে। সেখানে দরজাটির জায়গায় রয়েছে সিঁড়ি। এই সিঁড়িটি উঠে গেছে মসজিদের অভ্যন্তরে উত্তর-পশ্চিম দিকে দোতলার একটি বিশেষ কামরায়। কামরাটি পাথরের স্তম্ভের উপর অবস্থিত। মসজিদের গঠন অনুসারে এটিকে জেনানা-মহল বলেই ধারণা করা হয়। তবে অনেকে মনে করেন এটি ছিলো সুলতান বা শাসনকর্তার নিরাপদে নামাজ আদায়ের জন্য আলাদা একটি কক্ষ।
মসজিদটি তিনটি আইল ও পাচটি সারি (বে) তে বিভক্ত। মাঝের আইলটি পুরো স্থানটিকে দুভাগে বিভক্ত করেছে। প্রতিটি ভাগে রয়েছে ছয়টি চতুর্ভুজ আকৃতির অঞ্চল যেগুলোর উপরে অবস্থান করছে ছয়টি গম্বুজ। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খড়ের ছাদ বিশিষ্ট ঘরগুলো থেকেই এসেছে এধরনের নির্মাণশৈলী।পূর্ব দেয়ালের পাঁচটি দরজা বরাবর মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে পাঁচটি মিহরাব। এদের মধ্যে মাঝেরটি আকারে বড়। প্রতিটির নকশাই অর্ধ-বৃত্তাকার। মিহরাবগুলোতে পাথরের উপর অলংকরণ রয়েছে। দোতলার কামরাটিতেও একটি মিহরাব রয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তরের ৮টি স্তম্ভ ও চারপাশের দেয়ালের উপর তৈরি হয়েছে মসজিদের ১৫টি গম্বুজ। এদের দুপাশে দুসারিতে তিনটি করে মোট ১২টি গম্বুজ রয়েছে। এ মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, বাইরের যে কোনো পাশ থেকে তাকালে কেবল পাঁচটি গম্বুজ দেখা যায়, পেছনের গম্বুজগুলো দৃষ্টিগোচর হয় না।
পুরো মসজিদের অলংকরণে মূলত পাথর, ইট, টেরাকোটা ও টাইল ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদের সম্মুখভাগ, বুরুজসমূহ, দরজা প্রভৃতি অংশে পাথরের উপর অত্যন্ত সুক্ষ ভাবে লতাপাতা, গোলাপ ফুল, ঝুলন্ত শিকল, ঘণ্টা ইত্যাদি খোদাই করা রয়েছে। মাঝের দরজাটির উপরে একটি শিলালিপি পাওয়া যায়। ক্রেইটন ও কানিংহামের বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়, একসময় বাইরের দিকে পুরো মসজিদটির উপর সোনালী রঙের আস্তরণ ছিলো, আবার কেউ কেউ বলেন কেবল গম্বুজগুলোর ওপর সোনালী রঙের আস্তরণ ছিলো । গম্বুজগুলোর অভ্যন্তরভাগ টেরাকোটা সমৃদ্ধ।
যেভাবে যাবেনঃ-
ঢাকা থেকে সরাসরি বাস কিংবা ট্রেইনে চেপে সরাসরি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরে পৌঁছানো যায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে ৩৬ কিলোমিটার উত্তরে শিবগঞ্জ উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নে অবস্থিত ঐতিহাসিক এবং স্থাপত্য শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন এ মসজিদটি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে অটোতে করে সহজেই যাওয়া যায় সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন হিসেবে খ্যাত ছোট সোনা মসজিদ এলাকায়।