বৌদ্ধ, হিন্দু, মোঘল, পাঠান আমলসহ ইংরেজ শাসনামলের স্মৃতি বিজড়িত আমাদের এই গাইবান্ধা জেলা বিভিন্ন শাসনামলে নানা সংগ্রাম-বিদ্রোহ এ অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছে। তাই এই অঞ্চলে বিভিন্ন সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে নলডাঙ্গার জমিদারবাড়ি অন্যতম।
উপমহাদেশের প্রখ্যত নাট্যকার নাট্যশিল্পী, গীতিকার, সুরকার ও চলচ্চিত্র অভিনেতা তুলসী লাহিড়ীর স্মৃতি-বিজড়িত সাদুল্যাপুর উপজেলার নলডাঙ্গার জমিদারবাড়ি এ জেলার অতীত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বহন করে চলেছে। তুলসী লাহিড়ী (১৮৯৭-১৯৫৯ খ্রি:) নলডাঙ্গায় এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বি.এ. ও বি.এল. পাস করে তিনি প্রথমে রংপুর শহরে ও পরে কলকাতায় আলিপুর কোর্টে ওকালতি করেন। এ সময় তাঁর রচিত দুটি গান জমিরউদ্দিন খাঁ রেকর্ড করলে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তিনি পরিচিত হন। এর ফলে হিজ মাষ্টার্স ভয়েস ও মেগাফোন গ্রামোফোন কোম্পানীতে তিনি সঙ্গীত পরিচালকের পদ লাভ করেন। এক সময়ে তিনি আইন ব্যবসা ত্যাগ করে চলচ্চিত্র ও নাট্যাভিনয়ে যোগ দেন এবং ক্রমে মঞ্চাভিনেতা, চিত্রাভিনেতা, গীতিকার, নাট্যকার ও চিত্রপরিচালক হিসেবে দেশবরেণ্য হন।
তুলসী লাহিড়ী যখন চিত্রজগতে প্রবেশ করেন তখন ছিলো চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগ। ক্রমে সবাক যুগের প্রচলন হয় এবং তিনি পঞ্চাশটির ও বেশি ছবিতে অভিনয় করেন।
সামাজিক নিপীড়নের আলেখ্য অবলম্বনে ‘দু:খীর ঈমাম’ (১৯৪৭ খ্রি:) ও ‘ছেঁড়াতার’ (১৯৫০ খ্রি:) নাটক রচনা করে তিনি ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। তাঁর অসামান্য নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘মায়ের দাবি’ (১৯৪১ খ্রি:) ‘পথিক’ (১৯৫১ খ্রি:), ‘লক্ষ্মীপ্রিয়ার সংসার’ (১৯৫৯ খ্রি:) ‘মনিকাঞ্চন’, ‘মায়া কাজল’, ‘চোরাবালি’, ‘সর্বহারা’ প্রভৃতি। ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অসাড়তা প্রমাণ করার উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি নাটকগুলি রচনা করেন। তুলসী লাহিড়ীর ভাই গোপাল লাহিড়ী ছিলেন একজন ভারত-বিখ্যাত ক্ল্যারিওনেট বাদক। যে চাকরকে গোপাল লাহিড়ী বন্ধুক চালানো শিখিয়েছিলেন, সেই চাকরের গুলিতেই তিনি প্রাণ হারান মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। নলডাঙ্গার জমিদার বংশের এক বিখ্যাত কবির নাম শ্রী গোবিন্দ কেলীমুন্সি। তিনি দুটি গ্রন্থ রচনা করেছেন ‘সুধার আকর’ এবং ‘সংক্ষিপ্ত ভগবত’। এই নলডাঙ্গা জমিদার বংশের আরও একজন বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাঁর নাম গুরুদাশ তালুকদার। তিনি নাট্য অভিনেতা হিসেবেও সুনাম অর্জন করেছিলেন। নলডাঙ্গার উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্তিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ, শ্বেতপাথরের কৃষ্ণমন্দিরের অভিনব নির্মাণশৈলী মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ নির্মিত এই মন্দির গাত্রের শিলালিপি থেকে নলডাঙ্গার জমিদার বংশের কৃতিমান ব্যক্তি সুরেন্দ্রনাথ দেব শর্মা ও শ্রীমতি শৈলবালা দেবীর নাম পাওয়া যায়।
সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে গাইবান্ধার এইসব গৌরবোজ্জল প্রত্নসম্পদ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক। ঐতিহাসিক-এ নিদর্শনগুলোকে এখনই সযত্নে সংরক্ষণ করা না হলে একসময় সেসব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে চিরকালের মতো।
কিভাবে যাওয়া যায়:
সড়ক পথে ঢাকা হতে গাইবান্ধা যাওয়া যায়। ঢাকার গাবতলী, কল্যাণপুর, আব্দুল্লাহপুর থেকে গাইবান্ধাগামী বাস পাওয়া যায়। গাইবান্ধা জেলাতে কোন রেল সংযোগ নেই। লাহীরি বাড়ীতে যাওয়ার জন্য গাইবান্ধা জেলা থেকে ট্রেন,সিএন জি, অপিরক্সিা, মটর সাইকেল প্রাইভেট কার দিয়ে যাওয়া যায়। গাইবান্ধা ২৩ কিমিটার দূরুত্ব।