দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কাঠের তৈরি হস্তশিল্পসমৃদ্ধ দৃষ্টিনন্দন মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন বাংলাদেশের পিরোজপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী ‘মমিন মসজিদ’। বিচিত্র কারুকাজ ও ক্যালিগ্রাফি সমৃদ্ধ কাঠ দিয়ে তৈরি বিরল মসজিদ পিরোজপুরের ‘কাঠ মসজিদ’। স্থানীয়দের কাছে এ নামে পরিচিত হলেও প্রতিষ্ঠাতার নাম অনুসারে কাগজে কলমে এটি ‘মমিন মসজিদ’ নামে স্বীকৃত।
ফরায়জী আন্দোলনের অন্যতম নেতা মঠবাড়িয়ার প্রয়াত মৌলভী মমিন উদ্দিন আকনের একান্ত প্রচেষ্টায় ১৯১৩ সালে মঠবাড়িয়ার উদয়তারা বুড়িরচর গ্রামের আকনবাড়ির সামনে মসজিদটি নির্মিত হয়। তৎকালীন দিল্লীর ২২ জন কাঠ মিস্ত্রি মিলে কোন লোহার পেরেক ব্যবহার ছাড়াই সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদটি নির্মাণের উদ্যেক্তা মৌলভী মমিন উদ্দিন আকনের নামের সাথে মিল রেখে পরে মমিন মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে।
১৯১৩ সালে কাঠ মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কাঠ শিল্পের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলা থেকে তিনি হরকুমার নাথকে মাসিক ৪০ টাকা বেতনে মসজিদ তৈরির প্রধান মিস্ত্রি নিয়োগ করেন। ২২ জন মিস্ত্রী দীর্ঘ সাত বছর নিরলস কাজ শেষে ১৯২০ সালে মসজিদের নির্মাণ কাজ শেষ করেন। মমিন উদ্দিন সব সময় মিস্ত্রিদের কাছে থেকে তাদের কাজ পরিচালনা করতেন এবং কারুকাজ গুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখতেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মমিন মসজিদ তৈরিতে লোহাকাঠ ও সেগুনকাঠ ব্যবহার করা হয়েছে। কাঠগুলো মায়ানমার, ত্রিপুরা ও আসাম থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল। মসজিদের কাঠামো তৈরিতে লোহার পেরেক ব্যবহার না করে কাঠের শলা ব্যবহার করা হয়। ২৪ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১৮ ফুট প্রস্থের মসজিদটিতে টিন শেড দিয়ে চৌচালা তৈরি করা হয়। ভিতরে আলো বাতাস প্রবেশ ও সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য চালের মাঝখানে দ্বিতীয় আর একটি দো-চালা টিন শেড তৈরি করা হয়। মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি করে এবং পূর্ব ও পশ্চিমে চারটি করে জানালা রয়েছে। পূর্ব দিকে একটি মাত্র কারুকার্য খচিত দুই খাম্বা বিশিষ্ট দরজা রয়েছে, যাতে শিল্পকর্ম ফুটে উঠেছে। প্রবেশ দ্বারের উপরের বা দিকে আরবি অক্ষরে ইসলামের চার খলিফার নাম ও মাঝখানে হযরত মুহাম্মদ (সা:) নাম অলংকৃত করা হয়েছে। প্রবেশ দ্বারের মাঝখানের অংশে লেখা রয়েছে লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ।
বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী মসজিদটির জন্য উদয়তারা বুড়িরচর গ্রামের মূল সড়কটিও মমিন মসজিদ সড়ক নামে নামকরণ করা হয়েছে। কাঠের মসজিদটি বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম মসজিদের ২৩ তম স্থান দখল করে আছে।
ইউনিসেফ প্রকাশিত বিশ্বের অন্যতম মসজিদ নিয়ে প্রকাশিত ৪০০ পৃষ্ঠার একটি বইয়ে কাঠের এই মসজিদটির সচিত্র বর্ণনা স্থান পেয়েছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র কাঠের তৈরি শিল্পসমৃদ্ধ দৃষ্টিনন্দন মুসলিম স্থাপত্যকলার একটি নিদর্শন। সম্পূর্ণ কাঠের নির্মিত কারুকার্য ও ক্যালিগ্রাফি খচিত এই মসজিদটিতে কোনো ধরনের লোহা বা তারকাঁটা ব্যবহার করা হয়নি।
বাংলাদেশের সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত মসজিদের মধ্যে যেগুলো বেশি গুরুত্ববহন করে সেসব মসজিদের ছবি জাতীয় জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে। মঠবাড়িয়ার মমিন মসজিদের কয়েকটি আলোকচিত্র (বর্ণনাসহ) জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি শত বছরের পুরানো এই মসজিদটি ২০০৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ব বিভাগ সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা দিয়ে এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিলেও মসজিদটির জন্য কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
কিভাবে যাবেনঃ-
নদ-নদী ও সমুদ্র বেষ্টিত এই জেলায় যাতায়াতের জন্য নৌ-পথই সবচেয়ে সহজ যোগাযোগ মাধ্যম। এছাড়া সড়ক পথেও এই জেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। ঢাকা সদরঘাট নদী বন্দর লঞ্চ টার্মিনাল থেকে ঝালকাঠির উদ্দেশ্যে লঞ্চ ছেড়ে যায়। ঢাকা থেকে ঝলকাঠির উদ্দেশ্যে যেসব গাড়ি ছেড়ে যায় গুলিস্তান থেকে। ঢাকার সায়েদাবাদ ও গাবতলী উভয় বাস টার্মিনাল থেকেই ঢাকা-পিরোজপুর রুটের ফেরি পারাপার গাড়ি রয়েছে। সায়েদাবাদ থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলো মাওয়া সংলগ্ন পদ্মা নদী পার হয়ে পিরোজপুর যাতায়াত করে। আর গাবতলী থেকে ছেড়ে যাওয়া বাসগুলো পাটুরিয়া সংলগ্ন পদ্মা নদী পার হয়ে পিরোজপুর রুটে চলাচল করে। পিরোজপুর শহর থেকে যেকোনো ধরনের পরিবহনে আপনি সহজেই মঠবাড়িয়া উপজেলার মমিন মসজিদে যেতে পারবেন।