বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকের লেখাতে প্রায় প্রায়ই এই কথাটি উঠে আসে যে বাংলার পরদে পরদে ইতিহাস লুকানো রয়েছে। বাংলা আকাশ বাতাশ প্রকৃতি সবই রহস্যে ঘেরা। এই অপরুপ বাংলার আরেক বিস্ময় হল মধ্যযুগের প্রাচীন দুর্গনগরী ভিতরগড় যা কিনা পঞ্চগড় জেলায় অবস্থিত। উত্তরের আকাশচুম্বী হিমালয়, কাঞ্চনজঙ্ঘা, দার্জিলিং, চাবাগান, পাথর, পাথর উত্তোলনসহ অপরূপ সৌন্দর্য্যরে সাথে দেখে আসতে পারেন পঞ্চগড় জেলার প্রাচীন ইতিহাস সমৃদ্ধ মধ্যযুগের প্রাচীন দুর্গনগরী ভিতরগড় থেকে।
২৫ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এই দূর্গনগরীটি পঞ্চগড় জেলার শহর হতে ১৬ কিলোমিটার দূরে ভিতরগড় এলাকায় অবস্থিত। ১৭৪৭ সালে দেশভাগের পর বর্তমান এ দুর্গনগরীর কিছু অংশ ভারতের মধ্যে পড়েছে। বলা হচ্ছে এটি হচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ প্রত্মতাত্ত্বিক সম্পদ এবং প্রাচীন দূর্গনগরী। ২০১১ সালে পূরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনের আওতায় মধ্যযুগের এই দুর্গনগরীর ঢিবি, বেষ্টনী দেয়াল, মোড়েল রাজার গড়, মোহনা ভিটাসহ বিস্তীর্ন এলাকা সংরক্ষিত স্থান ঘোষণা করা হয়।
২০০৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ভিতরগড়ে সুপরিকল্পিত প্রত্নতাত্তিক সমীক্ষা, উৎখনন ও গবেষণা পরিচালনা করে এখানে ইট ও মাটি দ্বারা নির্মিত ৪টি বেষ্টনী (একটি অপরটির ভিতর অবস্থিত), বেষ্টনীসমূহ পরিবেষ্টিত পরিখা এবং ৬ থেকে ১২ শতকের মধ্যে নির্মিত ৮টি প্রাচীন স্থাপনার ভিত্তি কাঠামো আবিস্কৃত হয়। প্রত্নতত্ত্ববিদ ড. শাহনাজ হুসনে জাহান লীনা এ বিষয়ে জানান, নির্মাণ পদ্ধতি দেখে এগুলোকে গুপ্ত যুগের পরে সপ্তম শতক বা ১৪ শ বছর আগের তৈরি বলে অনুমান করা যায়। এছাড়া এসব স্থাপনা বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের বলেও আমাদের ধারণা।
ঐতিহাসিকদের মতে, ভিতরগড় পূর্ণ নির্মাণ করেন প্রাচীন কামরুনের শুদ্রবংশীয় রাজা দেবেশরের বংশজাত পৃথু রাজা। সম্রাট হর্ষবর্ধনের সময় পৃথু রাজার অভ্যুলয় ঘটে। তিনি কামরুপে পরাজিত হয়ে ভিতরগড় এলাকায় গমন করেন এবং নির্মাণ করেন এই ভিতরগড়। যা পৃথু রাজার রাজধানী। স্থানীয় আধিবাসীদের নিকট তিনি মহারাজা হিসাবে পরিচিত। ১৮০৯ সালে ফ্রান্সিস বুকানন ভিতরগড় জরিপ করেন। তাঁর মতে, পৃথু রাজার রাজত্ব তৎকালীন বৈকণ্ঠপুর পরগণার অর্ধেক ও বোদা চাকলার অর্ধেক অংশ নিয়ে গঠিত ছিল। ছয় শতকের শেষদিকে এক পৃথুরাজা কামরূপে পরাজিত হয়ে ভিতরগড়ে রাজ্য স্থাপন করেন। আবার তেরো শতকের কামরূপের ইতিহাসে এক রাজার নাম পৃথু। কেউ কেউ মনে করেন পৃথু রাজা ও রাজা তৃতীয় জল্পেশ অভিন্ন ব্যক্তি এবং আনুমানিক প্রথম শতকে তিনি ভিতরগড়ে রাজধানী স্থাপন করে এ অঞ্চলে রাজত্ব করেছিলেন।
ভিতরগড়ের দুর্গনগরীতে পৃথু রাজা নির্মাণ করেন এক বিশালাকার একটি দীঘি। যার পাড়সহ এর আয়তন প্রায় ৮শ থেকে ৪শ গজ। পাড়ের উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। জলভাগের আয়তন প্রায় চারশ ও দুইশ গজ। পানির গভীরতা প্রায় ৪০ ফুট বলে স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস। পানি অতি স্বচ্ছ। দিঘীতে রয়েছে মোট ১০টি ঘাট। নিম্নবর্ণের কিচক সম্প্রদায় দ্বারা আক্রান্ত হলে রাজা তার পবিত্রতা রক্ষার জন্য পরিবার পরিজন ও সৈন্য-সামন্তসহ দীঘির জলে প্রাণ বিসর্জন করেন।’ সেই থেকে দীঘিটির নামকরণ হয় মহারাজা দীঘি। এর ভিতরে মন্দির, প্রসাদ ও ইমারতের এবং সাবশেসে এবং বাইরে পরিখা ও মানীর প্রাচীর এখনো দেখা যায়।
কিভাবে যাওয়া যায়:
পঞ্চগড় কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল হতে তেঁতুলিয়াগামী বাসযোগে বোর্ড অফিস নামক স্থান হয়ে রিক্সা/ভ্যান যোগে পূর্বদিকে ০৫ কিলোমিটার দূরত্বেই প্রাচীন দুর্গনগরী ভিতরগড় ।