বিভিন্ন ধর্ম, অপরুপ প্রাকৃতি, হরেক রকম সংস্কৃতি নিয়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতির মানুষ বসবাস করে। এই সকল জাতি গোষ্ঠীর রয়েছে আলাদা আলাদা আচার অনুষ্ঠান এবং উপসানালয়। হবিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জগন্মোহনী সম্প্রদায়ের বিথঙ্গল আখড়াকে তাদের মধ্যে অন্যতম।
হবিগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বিথঙ্গল আখড়া। আখড়ার বর্তমান মোহন্ত (মঠাধ্যক্ষ) সুকুমার দাশ গোসাই জানান, জগন্মোহনী সম্প্রদায় একটি নবীন ধর্ম সম্প্রদায়। প্রায় সাড়ে ৪শ বছর আগে হবিগঞ্জ অঞ্চলে এই ধর্ম সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ঘটে। এ সম্প্রদায়ের প্রবর্তক শ্রী শ্রী জগন্মোহন গোস্বামী। তিনি হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার বাঘাসুরা গ্রামের অধিবাসী ছিলেন।
মাত্র ৩১ বছর বয়সে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। তার সমাধিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে মন্দির। তিনি ছিলেন আখড়ার প্রথম মোহন্ত। বিথঙ্গল আখড়াটি জগন্মোহনী সম্প্রদায়ের তৃতীয় মঠ। কিন্তু সামাজিক প্রভাব ও প্রাচুর্যের দিক দিয়ে এটি প্রধান স্থান দখল করে আছে। এক সময় এখানে ১২০ জন বৈষ্ণব বসবাস করতেন। তাদের বসবাসের জন্য এখানে আলাদা আলাদা কক্ষ রয়েছে। জানা গেছে, বৈষ্ণবরা এখানে একত্রে স্নান করতেন। তাদের একত্রে স্নান করার জন্য আখড়ার পাশের দীঘিতে সুদীর্ঘ শান বাঁধানো ঘাট তৈরি করা হয়। যা আজো ভগ্ন অবস্থায় বিদ্যমান।
আখড়ার অনেক দর্শনীয় বস্তুর মধ্যে রয়েছে এক হাজার কেজি (২৫ মণ) ওজনের শ্বেতপাথরের চৌকি, পিতলের সিংহাসন, রথ, রৌপ্য নির্মিত পাখি, মুকুট ইত্যাদি। আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ গোস্বামীর সমাধিস্থলের ওপর একটি সুদৃশ্য মঠ রয়েছে। মঠের সামনে আছে একটি নাট মন্দির, ভাণ্ডার ঘর ও ভোগ মন্দির। আখড়ার মোহন্ত সুকুমার দাশ গোসাই জানান, আখড়ার নিজস্ব ৪০ একর জমির উৎপাদিত ফসল ও ভক্তদের দানে এখানকার যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করা হয়। কথিত আছে, আগরতলার মহারাজ প্রয়াত কৃষ্ণ কিশোর মানিক্য বাহাদুর তার রানীকে নিয়ে প্রতি বছর বিথঙ্গল আখড়ায় আসতেন। তিনি এখানে দুই এক দিন অবস্থান করতেন।
মহারাজ যে চৌকিতে ঘুমাতেন সেটি এখনো সযতেœ রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। এই আখড়ায় প্রতি বছরই বিভিন্ন উৎসবাদি পালন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে কার্তিক মাসের শেষ দিন ভোলা সংক্রান্তি কীর্ত্তন, ফাল্গুন মাসে পূর্ণিমা তিথিতে দোল পূর্ণিমার পাঁচদিন পর পঞ্চম দোল, আষাঢ় মাসে দ্বিতীয় রথযাত্রা ইত্যাদি। এছাড়া চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে ভেড়ামোহনা নদীর ঘাটে ভক্তরা স্নান করেন। স্নান ঘাটে বিরাট বারুনি মেলা বসে। এখানকার প্রতিটি উৎসবে হাজার হাজার ভক্ত যোগদান করেন। ঐতিহ্যবাহী এই বিথঙ্গল আখড়াটিকে জগন্মোহনী সম্প্রদায়ের লোকজন অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করেন।
এটিকে ঘিরে ভক্তরা সারা বছরই বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন। কিন্তু এই আখড়ার অনেক দর্শনীয় বস্তু ইতোমধ্যে বিনষ্ট হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পুরাকীর্তি বিভাগ এটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। ফলে এই আখড়ার কিছুটা সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকিটা সংস্কার হলে বিথঙ্গল আখড়াটি আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। হবিগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জগন্মোহনী সম্প্রদায়ের বিথঙ্গল আখড়াকে গড়ে তোলা যেতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হিসেবে। এখানে রয়েছে বিশাল কিছু ইমারত। এসব ইমারতের আকর্ষণীয় নির্মাণশৈলী দর্শকদের বেশ আকৃষ্ট করে। সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই আখড়াটি যখন প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এটি সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
কিভাবে যাওয়া যায়:
শুকনো মৌসুমে হবিগঞ্জ কামড়াপুর ব্রীজ হতে জীপযোগে সুজাতপুর হয়ে নৌকোযোগে অথবা পায়ে হেটে বর্ষা মৌসুমে হবিগঞ্জ কালার ডুবা থেকে নৌকা অথবা বানিয়াচং আদর্শবাজার হতে নৌকাযোগে