কুড়িগ্রাম জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। কুড়িগ্রাম জনপদ হিসাবে কবে গড়ে উঠেছে তার সঠিক দিনক্ষণ পাওয়া না গেলেও জনপদ হিসেবে এ অঞ্চল যে প্রাচীন তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ অঞ্চলে আর্যরা আসার পূর্বে বাস করত অনার্যরা। পন্ডিত জাবুলিন শখের মতে প্রত্ম-প্রস্তর যুগে এ অঞ্চলে বাস করত অস্ট্রিক জাতিভুক্ত নিগ্রো সম্প্রদায়রা। তারপর এখানে সংমিশ্রণ ঘটে অনার্য দ্রাবির ও মঙ্গলীয়দের। এদের শংকর স্রোতে প্রাগঐতিহাসিক যুগে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় যে মানব সমাজ গড়ে উঠে তারাই মূলত কুড়িগ্রামের আদি অধিবাসী। কুড়িগ্রাম নামকরণ নিয়ে নানা মতবাদ থাকলেও কুড়িটি পরিবার অথবা অনার্যদের গণনার পদ্ধতি কুড়ি থেকে কুড়িগাঁও, কুড়িগঞ্জ পরবর্তীতে কুড়িগ্রাম নামকরণ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
১৮৭৫ সালের ২২ এপ্রিল কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী, নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ী এই ৮টি থানা নিয়ে কুড়িগ্রাম মহকুমার জন্ম হয়। এরপর ১৯৮৪ সালের ২৩ জানুয়ারি কুড়িগ্রাম সদর, নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী, রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী ও রাজিবপুর এই ৯টি উপজেলা নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলায় উন্নীত হয়।
নামকরনের ইতিহাস:-
কুড়িগ্রাম জেলার নামকরণের ইতিহাস নিয়ে অনেক কিংবদন্তি রয়েছে। এ বিষয়ে প্রশ্নাতীত বা সন্দেহমুক্ত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। সবই কিংবদন্তি ও প্রচলিত লোকশ্রুতি। তার কিছু কিছু বিষয় সমর্থনযোগ্য মনে হতে পারে। জানা যায়, কোন এক সময় মহারাজা বিশ্ব সিংহ কুড়িটি জেলে পরিবারকে উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুরূপে স্বীকৃতি দিয়ে এ অঞ্চলে প্রেরণ করেন। এ কুড়িটি পরিবারের আগমনের কাহিনী থেকে কুড়িগ্রাম জেলার নামকরণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বিলু কবীরের লেখা ‘বাংলাদেশের জেলা নমকরণের ইতিহাস’ বই থেকে জানা যায়, এখানে কুড়িটি মেচ্ তৈলজীবী পরিবারের বসতি ছিল বলে এ রকম নামকরণ হয়েছে। অন্য আরেকটি লোকশ্রুতি হলো : রঙ্গপুর অর্থাৎ এই অঞ্চল একদা ছিল কুচবিহার রাজ্যের অন্তর্গত। কুচবিহারের বাসিন্দাদের বলা হয় কোচ। এরা তিওড় গোষ্ঠীবিশেষও। মাছ ধরে বিক্রি করা তাদের পেশা। সুবিধাবঞ্চিত নীচু শ্রেণীর এই হিন্দু কোচদের কুড়িটি পরিবারকে সেখান থেকে এখানে প্রেরণ করা হয়েছিল বা আনয়ন করা হয়েছিল বসতি স্থাপনে জন্য। ওই কুড়িটি কোচ পরিবারের কারণে ‘কুড়িগ্রাম’ নামকরণ হয়েছে। আবার এমনও জানা যায়, এই গ্রামে কুরি বা কুরী নামক একটি হিন্দু আদিবাসী বা নৃগোষ্ঠী বসবাস করত বলেই অঞ্চলটির নাম হয় ‘কুড়িগ্রাম’। অদ্যাবধি এখানে ‘কুরি’ নামক আদিবাসী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস লক্ষ্য করা যায়। এখানো এ অঞ্চলে কুড়ি হিসেবে গোনার পদ্ধতি চালু রয়েছে। বিশিষ্ট প-িত জা পলিলুস্কি প্রমাণ করেছেন, গণনার এ পদ্ধতি বাংলায় এসেছে কোল ভাষা থেকে। কোল অস্ট্রিক ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। আরব অস্ট্রিক ভাষায় কুর বা কোর ধাতুর অর্থ হলো মানুষ। কুড়ি হিসেবে গোনার পদ্ধতিটিও এসেছে মানুষ থেকেই। এ অস্ট্রিক কারা? প-িতদের মতে, প্রত্নপ্রস্তর যুগে এ অঞ্চলে বাস করত নিগ্রো জাতি। এরপর আসে নব্যপ্রস্তর যুগ। আসামের উপত্যকা অতিক্রম করে আসে অস্ট্রিক জাতীয় জনগোষ্ঠী। তারপরে আসে দ্রাবিড় ও মঙ্গোলীয়রা। এদের মিলিত স্রোতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় মানবসভ্যতার সূচনা হয়। এরাই লাঙ্গল দিয়ে চাষের প্রবর্তন করেছে। কুড়ি হিসেবে গোনার পদ্ধতি করেছে চালু। নদনদীতে ডিঙি বেয়েছে, খেয়েছে শুঁটকি, খেয়েছে বাইগন বা বেগুন, লাউ বা কদু, কদলী বা কলা, জাম্বুরা, কামরাঙ্গা। করেছে পশু পালন। এঁকেছে কপালে সিঁন্দুর। করেছে রেশম চাষ। করেছে তামা, ব্রোঞ্জ ও সোনার ব্যবহার। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত দেশ শাসন করত ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’। ১৮৫৮ সালের পর শাসনকার্যের ক্ষমতা চলে যায় ব্রিটিশ সরকারের হাতে। এই ব্রিটিশ সরকারের আমলে কুরিগঞ্জ চারটি থানায় বিভক্ত ছিল। পরে ১৮৭৫ সালে ২২ এপ্রিল তারিখে একটি নতুন মহকুমার গোড়াপত্তন হয়। এ মহকুমার নাম ‘কুড়িগ্রাম’। কুড়িগ্রামঘেঁষা ব্রহ্মপুত্রের কারণে এখানে আসে বিভিন্ন আদিম জনগোষ্ঠী। এসব কারণে এখানে গড়ে উঠেছিল একটি সভ্যতাও। বিজিত আর্যদের কোন স্মৃতি এখানে নেই। তবে অন্যদের কিছু কিছু ক্ষীয়মাণ রাজচিহ্ন রয়েছে। বারো বা দ্বাদশ শতকের প্রথমপর্বে এ অঞ্চলে সেন রাজবংশের শাসনকাল আরম্ভ হয়। রাজারহাটের বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের চত্রা নামক গ্রামে এদের রাজধানী ছিল।এ বংশের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন রাজার নাম নীলধ্বজ সেন,চক্রধ্বজ সেন,নীলাম্বর সেন।সেনবংশের পতনের পর শুরু হয় মুঘল যুগ।
ভৌগোলিক সীমানা:-
কুড়িগ্রাম জেলার উত্তরে লালমনিরহাট জেলা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলা, দক্ষিণে গাইবান্ধা জেলা, পূর্বে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ধুবড়ী জেলা ও দক্ষিণ শালমারা মানকার চর জেলা এবং পশ্চিমে লালমনিরহাট জেলা ও রংপুর জেলা অবস্থিত।
উপজেলা ৯টি
উলিপুর উপজেলা
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা
চর রাজিবপুর উপজেলা
চিলমারী উপজেলা
নাগেশ্বরী উপজেলা
ফুলবাড়ী উপজেলা
ভুরুঙ্গামারী উপজেলা
রাজারহাট উপজেলা
রৌমারী উপজেলা
কৃতি ব্যক্তিত্ব:-
তারামন বিবি, বীর প্রতীক(মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য খেতাব প্রাপ্ত)
সৈয়দ শামসুল হক (প্রথিতযশা সাহিত্যিক)
আব্বাসউদ্দীন আহমদ (ভাওয়াইয়া সম্রাট হিসেবে খ্যাত। মূলত কুচবিহারে জন্মগ্রহণ করলেও
রংপুর বেতার কেন্দ্রে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন, কুড়িগ্রামের চিলমারী বন্দর নিয়ে গান রচনা করেছেন) কছিম উদ্দিন (ভাওয়াইয়া যুবরাজ হিসেবে পরিচিত)
বিখ্যাত স্থান:-
চান্দামারী মসজিদ
শাহী মসজিদ
চন্ডীমন্দির
দোলমঞ্চ মন্দির
ভেতরবন্দ জমিদারবাড়ি
পাঙ্গা জমিদারবাড়ি ধ্বংসাবশেষ
সিন্দুরমতি দীঘি
চিলমারী বন্দর
শহীদ মিনার
স্বাধীনতার বিজয়স্তম্ভ
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিফলক
পাঙ্গা জমিদারবাড়ির কামান
বঙ্গ সোনাহাট ব্রিজ
মুন্সিবাড়ি
কিভাবে যাবেন:-
সড়ক পথে ঢাকা হতে কুড়িগ্রামের দূরত্ব ৩৪৮ কিলোমিটার এবং রেলপথে ঢাকা হতে কুড়িগ্রাম রেল স্টেশনের দূরত্ব ৫৮৫ কিলোমিটার। ঢাকার গাবতলী, সায়েদাবাদ, আসাদগেট, শ্যামলী, মহাখালী, মিরপুর বাস স্টেশন থেকে কুড়িগ্রামে আসার সরাসরি দুরপাল্লার এসি ও নন-এসি বাস সার্ভিস আছে; এগুলোতে সময় লাগে ৬.৩০ হতে ৮.০০ ঘন্টা।
ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে ট্রেনে সরাসরি, অথবা লালমনিরহাট অভিমুখী ট্রেনে রংপুরের কাউনিয়া এসে সেখান থেকে সড়ক পথে কুড়িগ্রাম আসা যায়। কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে প্রতিদিন একাধিক ট্রেন কুড়িগ্রাম – কাউনিয়া পথে যাতায়ত করে।
কুড়িগ্রামে কোনো বিমানবন্দর না-থাকায় এখানে সরাসরি আকাশ পথে আসা যায় না, তবে ঢাকা থেকে সরাসরি বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে সৈয়দপুর বিমানবন্দরের সাথে; ঢাকা থেকে সৈয়দপুর এসে সেখান থেকে সড়কপথে কুড়িগ্রাম আসা যায়। বাংলাদেশ বিমান, জেট এয়ার, নোভো এয়ার, রিজেন্ট এয়ার, ইউনাইটেড এয়ার – প্রভৃতি বিমান সংস্থার বিমান পরিষেবা রয়েছে ঢাকা থেকে সৈয়দপুর আসার জন্য।