বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স
বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি এয়ারলাইন্স। বাংলাদেশি পতাকাবাহী এই বিমানটি প্রধানত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ঢাকা থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করে। এছাড়াও, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম এবং ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর,সিলেট থেকেও এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রী এবং মালামাল পরিবহনের পাশপাশি আভ্যন্তরিন সেবাও প্রদান করে থাকে। বিশ্বের প্রায় ৪২ টি দেশের সাথে এর আকাশ সেবার চুক্তি থাকলেও মাত্র ১৬টি দেশে এর কার্যক্রম পরিচালনা করে।
২০০৭ সালের ২৩ জুলাই তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এটি বাংলাদেশের সর্ব বৃহৎ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রুপান্তরিত হয়। এর প্রধার কার্যালয়ের নাম “বলাকা ভবন” যা ঢাকার কুর্মিটোলায় অবস্থিত। বিমান বাংলাদেশের যাত্রী সেবার একটা বিশাল অংশ হল হাজ্জযাত্রী আর বিদেশগামি যাত্রী। বর্তমানে কিছু ব্যক্তি মালিকানাধিন বেসরকারি বিমান প্রতিষ্ঠান চালু হওয়াতে প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে। এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গুলো উন্নত এবং বিশ্বস্ত সেবা দিয়ে ৮% হারে ক্রমবর্ধমান বাংলাদেশি বাজার সুবিধা গ্রহন করতে আগ্রহী। বাজারের এই উন্নতির জন্য কৃতিত্ব দিতে হয় প্রবাসী বাঙ্গালি ও পর্যটকদের।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে একক আধিপত্য বজায় রাখে। ১৯৯৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি ঘটতে থাকে। কিন্তু দুর্নীতি আর অসাধু ব্যাবস্থাপনার জন্য ১৯৯৬ এর পর লোকসান হতে থাকে। বাংলাদেশ বিমান সর্বোচ্চ ২৯ টি গন্তব্যে এর কার্যক্রম পরিচালনা করে। যার মধ্যে রয়েছে ঢাকা টু নিউ ইয়র্ক এবং ঢাকা টু টোকিয়ো ফ্লাইট। ২০০৭-এ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রুপান্তরিত হওয়ার পর কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়। বাংলাদেশ বিমান, বোয়িং এর সাথে ১০ টি বিমান ক্রয়ের জন্য চুক্তি করেছে।
বিমান বাংলাদেশ ইউরোপিয়ান সেফটি এজেন্সি দ্বারা স্বীকৃত, এছাড়াও আইএটিএ (IATA) এর নিরাপত্তা জনিত অডিট পাশ করে। যার কারণে বিমান বাংলাদেশ সহজে পুরাতন গন্তব্য গুলোতে তার ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারে।
ইতিহাস
রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ নং ১২৬ অনুসারে ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স গঠিত হয়। এদিন বাংলাদেশ বিমানবাহিনী থেকে একটি ডিসি-৩ বিমান নিয়ে জাতির বাহন হিসেবে বাংলাদেশ বিমান যাত্রা শুরু করে। সাবেক পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের ২৫০০ কর্মচারী ও কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা এবং ১০ জন বোয়িং ৭০৭ পাইলট ও ৭ জন অন্যান্য পাইলটের সমন্বয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি গঠিত হয়। প্রাথমিকভাবে এর নাম ছিল এয়ার বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল।
১৯৭২ এর ৪ ফেব্রুয়ারীতে আভ্যন্তরিন সেবার মাধ্যমে বিমান তার যাত্রা শুরু করে । ভারত থেকে নিয়ে আসা ম্যাকডনেল ডগলাস ডিসি-৩ ছিল প্রথম সংযোজন। ডগলাস ডিসি-৩ ঢাকার সাথে চট্টগ্রাম, যশোর এবং সিলেটের যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। এই ডিসি-৩ বিমানটি ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ এ পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের সময় দুর্ঘটনার মুখে পরে। এই দুর্ঘটনার পর ভারত সরকার বানংলাদেশকে আরও দুইটি ফকার এফ-২৭উপহার দেয়। অল্প সময়ের ব্যাবধানে বাংলাদেশ বিমানের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ব চার্চ কাউন্সিলের কাছ থেকে লোন নিয়ে ডগলাস ডিসি-৬ সংযোযন করা হয়। পরবরতিতে ডগলাস ডিসি-৬ এর পরিবর্তে ডগলাস ডিসি-৬বি নিয়ে আসা হয়, যা টোল এয়ার এর কাছ থেকে লিজ নেওয়া হয়েছিল। ডগলাস ডিসি-৬বি ঢাকা কলকাতা রুটে চলাচল করত। ১৯৭২ সালের চৌঠা মার্চ বিমান বাংলাদেশ, ব্রিটিশ সরকার থেকে পাওয়া একটি বোয়িং ৭০৭ চার্টার্ড প্লেন নিয়ে ঢাকা টু লন্ডনরুটে প্রথম সাপ্তাহিক আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে। ঢাকা–কোলকাতা রুটে নিয়মিত সেবা প্রদানের জন্য ১৯৭২ সালের ৩ মার্চ ভারত থেকে একটি ফকার এফ-২৭ আনা হয়। ওই বছর বিমান প্রায় ১,০৭৮ টি ফ্লাইটে ৩,৮০,০০০ জন যাত্রী পরিবহন করে এবং নতুন ৩ টি ফকার এফ-২৭ যোগ করে। এবং একটি বোয়িং ৭০৭-৩২০সি ১৯৮১ সালে ঢাকা টু হিথ্রো রুটে সংযোজন করা হয়।
ঢাকা-কোলকাতা রুটে নিয়মিত ২ টি ফ্লাইট পরিচালন করার জন্য ১৯৭৩ সালে আরো ৪ টি ফকার এফ-২৭ আনা হয়। একই সময় একটি বোয়িং ৭০৭ সংযুক্ত হলে বিমান ঢাকা টু লন্ডন সপ্তাহে ২ টি ফ্লাইট চালু করে। সে বছরেই বিমান চট্টগ্রাম টু কলকাতা রুটে সেবা প্রদান শুরু করে। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারী, কাঠমান্ডু, নভেম্বরে ব্যাংকক এবং ডিসেম্বরে দুবাই রুটে পরিসেবা চালু করে। ১৯৭৬ বিমান দুইটি ফকার এফ-২৭ বিক্রি করে একটি বোয়িং ক্রয় করে আবু ধাবি, করাচী ও মুম্বাই রুটেও সার্ভিস চালু করে। ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে আরও একটি বোয়িং কিনে সিঙ্গাপুরে এই পরিসেবা শুরু করে। পরের বছর বিমান তার ৪র্থ বোয়িং ক্রয়ের মাধ্যমে জেদ্দা, দোহা ও আমস্টারডাম রুটে সার্ভিস চালু করে এবং সে বছরেই বিমান পাবলিক সেক্টোর কোম্পানিতে রুপান্তরিত হয় এবং পরিচালনা পর্ষদ দ্বারা পরিচালিত হয়। ১৯৭৭-৭৮ অর্থ বছরে বিমান ব্রেক ইভেন পয়েন্ট স্পর্শ করে এবং পরের বছর লাভের মুখ দেখে। কুয়ালালামপুর, এথেন্স, মাসকট ও ত্রিপলির আন্তর্জাতিক রুট ১৯৭৯ সালে সংযুক্ত হয়। ১৯৮০তে ইয়াং ,টোকিও এবং ধাবাওং রুট ও চালু করে বিমান। ২০০৭ এ ম্যাকডনেল ডগলাস ডিসি ১০-৩০ ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুর বিমান বন্দরে অবতরন করে।
১৯৮৩ সালে আরও ৩টি ডিসি-১০ সংযুক্ত হয়। এছাড়াও বিমান বাগদাদ (১৯৮৩), প্যারিস (১৯৮৪) এবং বাহরাইনে (১৯৮৬) তাদের সেবা শুরু করে। ৫ অগাস্ট ১৯৮৪ তে বিমানের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ দূর্ঘটনা ঘটে, একটি ফকার বিমান চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা যাওয়ার পথে দূর্ঘটনায় পতিত হয়, যাতে প্রায় ৪৯ জন যাত্রী মৃত্যুবরন করেন। এর পর লম্ভা দূরত্বর ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ১৯৯৬ সালে বিমান দুইটি দূরপাল্লার এয়ারবাস এ৩১০ ক্রয় করে। এর পর ২০০০ সালে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইস আর জ্যামাইকা এয়ারলাইন্স থেকে ভাড়ায় আনা দুইটি এয়ারবাস এ৩১০ সংযোজন করা হয়। এছাড়া ২০০৩ এ আরও একটি ভাড়ায় আনা এয়ারবাস এ৩১০ বহরে যোগ হয়।
২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে বিমান ১১,৫০,০০০ জন যাত্রী পরিবহণ করে, যা বিগত দশকের তুলনায় দুইগুন আর ৭০ ভাগ বেশি। প্রাইভেট সার্ভিস চালু হলে বিমান ৩৫ ভাগ বাজার হারায় এবং গড়ে বছরে ১,৬২,০০০ জন অভ্যন্তরীণ যাত্রী পরিবহণ করে। একই সময় বিমান ইতিহাসে সর্ববৃহৎ লোকসানের মুখ দেখে, যার পরিমাণ প্রায় ৮ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা। পরের বছর লোকসান হয় প্রায় ৬ কোটি ৯০ লক্ষ টাকা। সে সময় বিমান তার জ্বালানী সরবরাহকারী, বাংলাদেশ পেট্রলিয়াম করপোরেশনকে এক মিলিয়ন ডলারের তেলের বিলও পরিশোধ করতে পারেনি।
ব্যাবস্থাপনা
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সূচনালগ্ন থেকেই এর পুরো মালিকানা ছিল বাংলাদেশ সরকারের। ১৯৭৭ সালে বিমানকে একটি পাবলিক সেক্টর করপরেশনে পরিনত করা হয় যা এর পরিচালক ও কর্মকর্তাদের কিছুটা স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল। ১৯৮৭ সাল বিমানের পরিশোধিত মূলধন আরো দুই হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি করা হয়। এবং সর্বশেষে ২০০৭ সালে যখন বিমানকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিনত করা হয় তখন এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিনত হয়।
আশির দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বিমানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শুরুর দিকে কিছু উন্নয়ন ও সম্প্রসারন হলেও এর অদক্ষ্য ব্যাবস্থাপনা ও ব্যাপক দূর্নিতীর কারণে ধীরে ধীরে এর লাভ কমতে শুরু করে। সেই দূর্নিতীগুলোর মধ্যে ছিল লোক দেখানো জিনিষপত্র ক্রয়, ভুয়া মেরামত বিল, রাজনৈতিক কারণে অলাভজনক রুটে বিমান চালনা ইত্যাদি। ১৯৯৬ সালের একটি গবেষনায় দেখা যায় যে শুধুমাত্র দাফতরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিমানে ৫২৫৩ জন কর্মকর্তা ছিল যেখানে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স প্রায় সমান সংখ্যক দাফতরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে বিমান বাংলাদেশের চেয়ে দশগুন বেশি বিমান পরিচালনা করতে সক্ষম ছিল। এই গবেষনাই প্রমান করেছিল যে তৎকালীন বিমান মূলধন স্বল্পতায় ভূগছিল এবং রাজনৈতীক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছিল।
বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য থেকে জানা যায় যে ৯২-৯৩ অর্থবছরে বিমান বাংলাদেশের কাছে সরকারের কর বাকি ছিল প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ টাকা। ১৯৯৯ সালের বিমান বাংলাদেশের উপর পরিচালিত এক অডিট থেকে জানা যায় যে বিমানের এর টিকিট বিক্রয় প্রতিনিধিদের (সেলস এজেন্ট) কাছে প্রায় ২২ লক্ষ টাকা পাওনা আছে যা বিমানেরই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজসে সম্ভব হয়েছিল। উপরন্তু এই টিকিট বিক্রয় প্রতিনিধিদেরকে অতিরিক্ত ২৪ লক্ষ টাকা কমিশন হিসেবে অগ্রিম দেওয়া হয়েছিল যা বিমান বাংলাদেশের নিয়ম বহির্ভূত। ২০০৭ সালে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দূর্নিতী প্রতিরোধের অংশ হিসেবে বেশ কয়েকটি দূর্নিতীর অভিযোগ সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাই বাংলাদেশ বিমানের সাবেক ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার শামীম ইস্কান্দারকে গ্রেফতার করে। শামীম ইস্কান্দারের গ্রেফতারের আগে তার সহযোগী আরো প্রায় পয়ত্রিশ জন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়।
পরিচালনা পর্ষদ
বিমান পরিচালনা পর্ষদে তৃতীয়বারের মতো চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এয়ার মার্শাল (অব.) মোহাম্মদ ইনামুল বারী । ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ফারহাত হাসান জামিল । এর আগে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে এএম মোসাদ্দিক আহমেদ কর্মরত ছিলেন। পরিচালনা পর্ষদের পরিচালক হিসেবে যাদের নিযুক্ত করা হয়েছে এরা হলেন-অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, সহকারী বিমানবাহিনী প্রধান (অপারেশন অ্যান্ড ট্রেনিং), বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার ইন চিফ, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) এম খুরশিদ আলম, বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজিবুল আলম, ইমার্জিং রিসোর্সেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুর ই খোদা আব্দুল মবিন ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও (পদাধিকারবলে)।
মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জনসংযোগ বিভাগের উপ মহাব্যবস্থাপক তাহেরা খন্দকার[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]। এর আগে জনসংরযাগ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন মহাব্যবস্থাপক শাকিল মেরাজ। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত বিমানের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এয়ার মার্শাল (অবঃ) জামাল উদ্দিন আহমেদ এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাইল হেউড কর্মরত ছিলেন। এর আগে ২০১৩ সালের মার্চ মাস থেকে ২০১৪ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে ছিলেন কেভিন স্টিল। তিনি ছিলেন বিমানের ইতিহাসে সর্বপ্রথম বিদেশি প্রধান নির্বাহী। তাকে অন্যান্য ৪২ জন স্থানীয় ও বিদেশি প্রার্থীর মধ্য থেকে বাছাই করা হয়। বিমানে যোগদানের পর একটি সংবাদ সম্মেলনে কেভিন স্টিল বিমানকে একুশ শতকের আধুনিক ও লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিনত করার প্রতিজ্ঞার কথা উল্লখ করেছিলেন যদিও নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে প্রায় এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর বিভিন্ন মাধ্যমে তার সাফল্য নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ ছিল, ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে তিনি এমডি ও প্রধান নির্বাহীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
বেসরকারীকরণ
১৯৯০ সালের পর থেকে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতীক ক্ষতির কারণে বাংলাদেশ সরকার বিমান বাংলাদেশকে বেসরকারীকরনের সিন্ধান্ত নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় সরকার ২০০৪ সালে বিভিন্ন বিদেশি বিনিয়োগকারীর কাছে বিমানের চল্লিশ শতাংশ শেয়ার বিক্রয়ের করার প্রস্তাব দেয়। এই প্রস্তাবে উল্লেখ ছিল যে বাংলাদেশ সরকার বিমানের কিছু নিয়ন্ত্রন সরকার সংরক্ষন করতে চায়। এই প্রস্তাব বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয় না উপরন্তু প্রস্তাবটি তৈরী এবং নিরীক্ষন করার পেছনে বেসরকারী তদারকি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করায় সরকারের ১.৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হয়।
২০০৭ সালের মে মাসে বাংলাদেশের তত্বাবধায়ক সরকার বিমানকে একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিনত করার পরিকল্পনা মঞ্জুর করে যার শেয়ারের মালিকানা সাতটি সরকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মানব সম্পদ ও যন্ত্রপাতির অনুপাত কমিয়ে আনার জন্য সরকার বিমানের কর্মকর্তাদের জন্য একটি স্বেচ্ছা অবসরের রুপরেখা প্রনণয়ন করে। তৎকালীন বিমান বাংলাদেশে বিমান এবং মানব সম্পদের অনুপাত ছিল ৩৬৭:১, কিন্তু একই শিল্পে অন্যান্ন এশিয়ান সংস্থাগুলো ১৫০:১ অনুপাত বজায় রেখেছিল। চাকুরীর মেয়াদ অনুযায়ী স্বেচ্ছা অবসরের পাওনাদি ঘোষিত হয়েছিল এবং বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে ঋনে নেওয়া ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে তা পরিশোধের ব্যাবস্থা করা হয়েছিল। এই পরিকল্পনা থেকে বিমান প্রায় ১৬০০ কর্মী কমিয়ে আনার পরীকল্পনা করেছিল কিন্তু ২১৬২ জন কর্মী স্বেচ্ছা অবসরের জন্য আবেদন করে। এদের মধ্য থেকে ১৮৭৭ জনের আবেদন বিমান ব্যাবস্থাপনা গ্রহন করে
২৩ জুলাই ২০০৭ এ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিনত হয়। প্রথমে এটির নাম পূর্বের বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স রাখার সুপারিশ করা হলেও পরে তা বাতিল করা হয়। সরকার এর পূরো পনেরো লক্ষ শেয়ারেরই মালিক যদিও সরকার ৪৯% শেয়ার ব্যক্তিগত খাতের মালিকানায় দিয়ে বাকি ৫১% শেয়ার সরকারি মালিকানায় রেখে এর নিয়ন্ত্রন ধরে রাখতে চেয়েছিল। পূনর্গঠনের পর এর সাবেক ব্যাবস্থাপনা পরিচালক ডঃ আব্দুল মোনেমকে পুনরায় ব্যাবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। বাকী ছয়জন পরিচালককে জ্বালানী, বাণিজ্য, অর্থ, বেসামরিক বিমান চলাচল, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কেবিনেট ডিভিশন থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কেবিনেট সচিব বিমানের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন। এই ছয় মন্ত্রনালয়ের সচিব ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রনালয়ের যুজ্ঞ সচিবকে সমানভাবে বিমানের শেয়ারের মালিকানা দেওয়া হয়। সরকার ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এয়ার কমোডর জাহেদ কুদ্দুস (অবঃ) কে ডঃ আব্দুল মোনেমের স্থলাভিষিক্ত করে। এয়ার কমোডর জাহেদ কুদ্দুস (অবঃ) এ আগে ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অফ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর পূর্বে তিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বিভিন্ন উচ্চপদস্থ পদে কর্মরত ছিলেন।
পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রুপান্তরীত করার আগে যেসকল কর্মী স্বেচ্ছা অবসর পরীকল্পনায় চকুরী ছেড়েছিলেন তারা সমন্বিতভাবে বিয়ানে একটি প্রতিযোগী এয়ারলাইন্স গঠন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন যার জন্য এয়ার বাংলা ইন্টারন্যাশনাল, বিমান ইমপ্লইজ এয়ারলাইন ও বলাকা নামগুলি প্রস্তাব করা হয়েছিল। বিমানের সাবেক ব্যাবস্থাপনা পরিচালক এবং বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স পাইলট এসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিইডেন্টও তাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে এই বিষয়ে আর কিছু শোনা যায় নি।
যাত্রী সেবা
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বাজে গ্রাহকসেবার জন্য সকলের কাছে পরিচিত। অনিয়ন্ত্রিত সময়সূচীর জন্য ২০০৭ সালে বিমান লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরও দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট সহ অন্যান্য বড় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলো থেকে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয় ২০০৭ সালের গ্রিষ্মে লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দর পরিচালনাকারী সংস্থা বিএএ বিমানকে প্রমানসহ একটি চিঠি দেয় যাতে উল্লেখ ছিল যে বিমান ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই বরাদ্দকৃত সময়সূচীতে হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরন করে নি যা ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট এসোসিয়েশন (IATA) এর নিয়মানুযায়ী বাধ্যতামূলক। এবং পরবর্তী গ্রীষ্মে যদি বিমান লন্ডনে পরিসেবা চালু রাখতে চায় তাহলে হিথ্রো বিমানবন্দরের আশা ছেড়ে দিয়ে স্ট্যান্সড বা গেটউইক বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারে। পরবর্তী বছর বিএএ এর সাথে অলোচনায় বসে বিমান এই মর্মে আশ্বস্ত করে যে এটি বরাদ্দকৃ অবতরন সময়সূচীর অন্তত পক্ষে ৮০% ব্যবহার করবে। এর ফলে ২০০৮ সালে বিমান লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরনের অনুমতি পায়। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে বিমানের একটি ডিসি ১০ দিয়ে পরিচালিত ঢাকা-লন্ডন সরাসরি সেবার একটি বিমান হিথ্রো বিমানবন্দরে তার নির্ধারিত সময়ের তিন ঘন্টা পর পৌছালে তাকে হিথ্রোতে অবতরন করার অনুমতি না দিয়ে জ্বালানী ভরার জন্য গেটউইক বিমানবন্দরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ২০০৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বরে দি টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে হিথ্রো বিমানবন্দরের সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিমান সংস্থা হিসেবে আক্ষা দেওয়া হয় যার প্রত্তেকটি বিমানে প্রায় তিন ঘন্টা করে দেরি হয়। ২০০৮ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা, সুরক্ষা এবং সময়সূচি না মানার কারণে এর কর্মীদের বাংলাদেশ বিমানে ভ্রমন না করার সতর্কতা জারি করে। তাসত্বেও যারা বাংলাদেশ বিমানে ভ্রমন করেছে তারা নিজ দায়িত্বে ভ্রমন করেছে এবং তাদের বীমার টাকা দাবি করতে পারে নি। বাংলাদেশ বিমানের নুতুন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জানান ২০০৮ সালের এই ঘটনা সম্পর্কে তিনি জানতেন না। তিনি আরো যোগ করেন যে সে সময় বিমান সময়সূচী মেনে চলতে হিমশিম খাচ্ছিল এবং আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই তা নিয়ন্ত্রনের মধ্যে চলে আসবে।
ভ্রমণ শ্রেণী ও সুযোগ সুবিধা
সাধারনত বড় এবং সুপরিসর বিমানগুলোতে দুই ধরনের ভ্রমণ শ্রেণী (বিজনেস ক্লাস ও ইকোনমি ক্লাস) রয়েছে কিন্তু ছোট এবং অল্প পরিসর বিমানগুলোতে শুধুমাত্র একটি ইকোনমি ক্লাস সেবা প্রদান করা হয়। এয়ারবাস এ৩১০ ঘরানার বিমানগুলোতে মসলিন এক্সিকিউটিভ শ্রেনীর আসন ২-৩-২ বিন্যাসে সাজানো আছে অপরদিকে ম্যাকডনাল ডগলাস ডিসি ১০-৩০ বিমানগুলোতে যাত্রীদের আরো বেশি জায়গা দিয়ে ২-২-২ বিন্যাসে সাজানো থাকে। ইকোনমি ক্লাসে সচরাচর আসনগুলো ২-৫-২ ভাবে বিন্যাসিত থাকে।
বিমানে ইংরেজী এবং বাংলা উভয় ভাষার জাতীয় দৈনিক পত্রিকা দেওয়া হয়ে থাকে।
ডিসি ১০-৩০ বিমানগুলির প্রত্যেকটি কেবিনে প্রজেক্টরের সাহায্যে প্রদর্শনের ব্যাবস্থা আছে অপরদিকে এয়ারবাস এ৩১০ বিমানে ছাদের লাগেজ রেকে ঝুলন্ত মনিটরের ব্যাবস্থা আছে। তবে আধুনিক বিমানগুলোতে যাত্রিদের ব্যক্তিগত পছন্দ অনুযায়ী অনুষ্ঠান দেখানোর সুবিধার জন্য প্রত্তেকটি আসনের পিছনেই এলসিডি মনিটর লাগানো আছে। পুরাতন বিমানগুলোর ক্ষেত্রে উৎপাদনের সময় এগুলোতে যে ধরনের সুযোগ সুবিধা ছিলো বাংলাদেশ বিমান সেগুলোই অব্যাহত রয়েছে।
২০০৭ সালে আইএটিএ এর নির্ধারিত ই-টিকেটিং নিয়ম প্রবর্তন করার জন্য বিমান এমাডিউস নামক এক কোম্পানির সাথে চুক্তি করে। আইএটিএ এর সকল সদস্যদের জন্য এই ই-টিকেটিং নিয়ম চালু করার শেষ সময় ছিল ৩১শে ডিসেম্বর ২০০৭। আইএটিএ এর সদস্য হওয়া সত্বেও বিমান এই সময়সীমার মধ্যে ই-টিকেটিং পদ্ধতি চালু করে নি। এর অন্যতম কারণ ছিল এমাডিউসের স্থানিয় অফিস, আদালত কর্তৃক মানি লন্ডারিং এর অভিযোগে অভিযুক্ত ছিল এর সকল কর্যক্রম নিষিদ্ধ হয়েছিল। যদিও মাসখানেকের মধ্যেই উচ্চ আদালতে আপিলের মাধ্যমে তারা কার্যক্রমে ফিরে আসে।
পণ্য পরিবহন
বিমান বাংলাদেশ যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি, যাত্রী পরিবহনের বিমানগুলোর মালামাল রাখার জায়গা ব্যবহার করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গন্তব্যে মালামাল পৌছানোর কাজও করে থাকে। এই জন্য বিমান হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতীক বমানবন্দরে একটি কার্গো ভিলেজ প্রতিষ্টা করেছে যেখানে বিদেশে পাঠানোর আগে মালামাল প্যাকেজিং এবং লেবেলিং করা হয়
বিমান বাংলাদেশ ২০০৩-০৪ অর্থবছরে মালামাল পরিবহনে ১৬.৫% প্রবৃদ্ধি অর্জন করে যেখানে অন্যান্য বিমান পরিচালনা সংস্থা যেমন বিসমিল্লাহ এয়ারলাইন্স, বেষ্ট এভিয়েশন, এয়ার বাংলাদেশ সহ অন্যান্য বেসরকারী সংস্থাগুলো একই অর্থবছরে ১০৮% প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। তা সত্বেও বিমান পণ্য পরিবহনে বেশ শক্ত অবস্থানে ছিল। এই বেসরকারী সংস্থাগুলো পণ্য পরিবহন পরিসেবার বাজার ১০.৬% বৃদ্ধি করতে সক্ষয় হয়। মোট ৯৯,০০০ টন পণ্যের মধ্যে ৪৭% মালামাল বিদেশি বিমান পরিবহন সংস্থা, ২৪% বেসরকারী সংস্থাগুলো এবং বিমান মাত্র ২৯% মালামাল পরিবহন করেছিল।
যাত্রীসেবার সাথে, পণ্য পরিবহনেও বিমানে মারাত্বক রকম দূর্নিতি হত। ২০০৪ সালে এক তদন্ত প্রতিবেদন দেখা যায় যে মধ্যপ্রাচ্যে বিমানের পণ্য পরিবহন পরিসবায় সরকার মিলিয়ন ডলার রাজস্ব হারিয়েছে
গন্তব্যসমূহ
অভ্যন্তরীণ বিমান যাতায়াত ব্যবস্থায় দেশের আকাশসীমা ব্যবহার করে বিভিন্ন বিমানবন্দরে যাতায়াত করা যায়, আর আন্তর্জাতিক বিমান যাতায়াত ব্যবস্থায় শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিদেশে গমনাগমন করা যায়।
বিমান বাংলাদেসশের সাথে ৪৩ টি দেশে যাত্রীসেবা পরিচালনা করার চুক্তি থাকলেও বিমান স্বল্পতার কারণে মাত্র ১৬ টি দেশে সেবা কার্যক্রম অব্যাহত আছে। বর্তমানে বিশ্বের ১৬ টি শহরে ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স তাদের সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। এশিয়া ও ইউরোপ – এ দু’টি মহাদেশে চলাচলকারী রুটসমূহ হচ্ছে: – লন্ডন, রোম, ম্যানচেষ্টার, মিলান, কুয়েত, দোহা, কুয়ালালামপুর, কোলকাতা, দিল্লি, কাঠমান্ডু, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, হংকং ইত্যাদি।
ক্রমেই বিদেশি বিমান সংস্থাগুলো বিমানের পূর্বের লাভজনক গন্তব্যগুলি দখল করে নিচ্ছে। যেমন ঢাকা–লন্ডন রুটে যেখানে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ ও বিমান বাংলাদেশের একছত্র আধিপত্য ছিলসেখানে এমিরেটস ও এয়ার ইন্ডিয়া সহ অন্যান্য বিমান সংস্থাগুলো এই রুটটিকে লাভজনক রুট হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিমান বাংলাদেশের এই বিমান স্বল্পতা ও অব্যাবস্থাপনাকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটেন প্রবাসীদের ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ও রয়েল বেঙ্গল এয়ারলাইন্স সহ অন্যান্য বিমান সংস্থাগুলো সিলেট–লন্ডন রুটে বিমান পরিবহন সেবা প্রদান করার পরীকল্পনা খতিয়ে দেখছে।
২০১৩ সালে বিমান বাংলাদেশ সারা বিশ্বে সয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ই-টিকেটিং চালু করার উদ্দেশ্যে হান এয়ারের সাথে চুক্তি সম্পন্ন করে।
নিউ ইয়র্ক ও ম্যানচেষ্টার
১৯৯৩ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিমান বাংলাদেশ ব্রাসেলস হয়ে নিউ ইয়র্কের জন এফ. কেনেডি বিমানবন্দরে যেবা প্রদান করে। এই ঢাকা– নিউ ইয়র্ক রুটটিই বিমানের জন্য সবচেয়ে সম্মানজনক রুট ছিল এবং বিমানের স্বল্পতা ও ক্রমবর্ধমান ক্ষতির সম্মুখিন হওয়া সত্বেও জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরের ল্যান্ডিং স্লট ধরে রাখার জন্য বিমান অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল। কারণ একবার জন এফ. কেনেডি বিমানবন্দরে ল্যান্ডিং স্লট হারিয়ে ফেললে তা পূনরুদ্ধার করা কঠিন ছিল। ক্ষতির পরিমাণ কমাবার লক্ষে এবং ব্রিটেনের উত্তরে ম্যানচেষ্টারে বসবাসরত বাংলাদেশিদের চাহিদা পূরনের লক্ষে বিমান নিউ ইয়র্ক যাওয়া এবং আসার পথে ম্যানচেষ্টারে যাত্রাবিরতী দেওয়ার পরীকল্পনা করে। ৮ এপ্রিল ২০০৬ সালে নিউ ইয়র্ক যাবার পথে বিমান সর্বপ্রথম ম্যানচেষ্টার বিমানবন্দরে অবতরন করে। যদিও এর আগে ফেডারেল এভিয়েশন এডমিনেষ্ট্রেশন (FAA) বিমানকে দ্বিতীয় শ্রেণীর বিমান পরীবহন সংস্থা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। দ্বিতীয় শ্রেনীর অন্তর্ভুক্ত বিমান সংস্থাগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দরগুলোতে অবতরন করতে কিছু বাধ্যবাধকতা সম্মুখিন হতে হয়। এই বাধ্যবাধকতা সত্বেও বিমান নিউ ইয়র্কে সেবা কার্যক্রম চালু রাখতে সক্ষম হয়েছিল কিন্তু ফ্লাইট সংখ্যা বাড়ানো ও নতুন ল্যান্ডিং স্লট পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পরেছিল।দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত বিমান সংস্থাগুলো অন্তত দুই বছরের জন্য তাদের নির্ধারিত সময়সূচী এবং গন্তব্যে কোন ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে না। কিন্তু বিমান বাংলাদেশ নিউ ইয়র্ক-ঢাকা ফ্লাইটটি ব্রাসেল্সে ট্রানজিট না দিয়ে সেটি ম্যানচেষ্টারে ট্রানিজিট দেওয়ার এফএএ (ফেডারেল এভিয়েশন অথরিটি) বিমানকে জরিমানা করে। ফলে বিমান ম্যানচেষ্টারে ট্রানজিট বাতিল করে পুনরায় ব্রাসেল্সে ট্রানজিট দেয়।
এফএএ বিমান বাংলাদেশকে এর ডিসি ১০ বিমানটি পরিবর্তন করার ব্যাপারে সতর্ক করে দেয় কারণ এই বিমানটি অতি পুরানো হওয়ায়, কোন সমস্যা হলে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেওয়ার মত যথেষ্ট সুরক্ষিত নয়। ২০০৬ সালের ১৩ মে ডিসি ১০ বিমানের নিরাপত্তা জনিত কারণে এফএএ বিমানের বিজি০০১ ফ্লাইটকে নিউ ইয়র্কের আকাশসীমায় প্রবেশের অনুমতি দেয় নি। পরে এই বিমানটি কানাডার মন্ট্রিয়েল-পিয়ের ইলিয়ট ট্রুডু আন্তর্জাতীক বিমনবন্দরে অবতরন করে এবং এর যাত্রীরা অন্য একটি বিমানে তাদের গন্তব্যে পৌছায়। কানাডিয় বিমান প্রশাষন বিমানটিকে পর্যবেক্ষন করে কোন সমস্যা নেই বলে মন্তব্য করলে এফএএ পরবর্তীকালে দুঃখ প্রকাশ করে জানায় যে এটি তাদের ভুল ছিল। সেবার কানাডা থেকে বিমানটি কোন যাত্রী না নিয়েই ঢাকা ফিরে আসে। এই ঘটনার পর থেকেই পুরাতন হয়ে যাওয়া এই ডিসি ১০ বিমান এবং প্রত্তেক যাত্রায় প্রায় ৮০,০০০ ইউএস ডলার লোকসান করতে থাকা এই রুটটি বিমান বন্ধ করে দেয়। এই বিমানটিকে অন্যান্য স্থানিয় এবং আন্তর্জাতীক রুটে চালিয়ে বিমান তার অব্যাহত লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার পরীকল্পনা করে। সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারেরআমলে বিমানের নিউ ইয়র্ক রুটটি পুনরায় চালু করার পরীকল্পনা করা হয়। এর আগে জন এফ. কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ফ্লাইট পূনর্বহাল করার জন্য ২০০৮ সালের ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেধে দেয়, এবং এই সময়ের পরে স্থায়ীভাবে বিমানের অবতরন সময়সূচী বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়।[৫৪] ক্ষতির সম্মুখিন হওয়া সত্বেও গুরুত্বপূর্ন হওয়ায় যুক্তরাজ্য সরকারের সাথে একটি চুক্তি পূনর্বিবেচনা করে, বিমান ২০১০ সালে ভাড়ায় আনা একটি বোয়িং ৭৭৭ বিমান দিয়ে পুনরায় ঢাকা–ম্যানচেস্টার–নিউ ইয়র্ক ফ্লাইট চালু করার পরীকল্পনা করে।
হজ্জ্ব ফ্লাইট
বাংলাদেশের হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলিম প্রতি বছর হজ্জ্বব্রত পালন করতে মক্কায় যান। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সই হল একমাত্র বাংলাদেশি ব্বিমান সংস্থা যা প্রতি বিছর জেদ্দার কিং আব্দুল আজিজ বিমানবন্দরে প্রতি বছর হজ্জ্বযাত্রী পরীবহন করে থাকে। বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ যেমন প্রধানমন্ত্রী বা বিমান মন্ত্রী প্রতি বছর এই হজ্জ্ব ফ্লাইটের উদ্বোধন করে থাকেন।
সরকার ২০০২ সালে একবার বেসরকারী বিমান সংস্থাগুলোর জন্য এই পরিসেবা উন্মুক্ত করেছিল। এয়ার বাংলাদেশ হল সর্বপ্রথম বেসরকারী বিমান পরীবহন সংস্থা যারা হজ্জ্ব ফ্লাইট পরিচালনা করে। কিন্তু বেসরকারী এই বিমান সংস্থা সেই বছর বিবিন্ন যাত্রায় প্রায় সর্বোচ্চ নয় দিন পর্যন্ত বিলম্ব করায় পুনরায় বিমান বাংলাদেশ একচ্ছত্র আধিপত্যে ফিরে যায়।
বিমানের হজ্জ্ব ফ্লাইটগুলো আজ পর্যন্ত কখনই ঝামেলামুক্ত ছিল না। ২০০৫ সালে হজ্জ্ব ফ্লাইটের জন্য অতিরীক্ত ভাড়া ধার্য করার অভিযোগে তৎকালীন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। ২০০৬ সালে বর্ধিত চাহিদার কথা বিবেচনা করে ২০০৬ সালে বিমান বাংলাদেশ এর সমস্ত হজ্জ্ব ফ্লাইট থেকে প্রথম শ্রেণী সরিয়ে নেয়ার মত নজিতবিহীন সিদ্ধান্ত নেয়। অপরদিকে হজ্জ্ব এজেন্সিগুলো নিয়মনিতী মেনে না চলার জন্য হজ্জ্বযাত্রীদের ভিসা প্রাপ্তি বিলম্ব হলে বিমান বাংলাদেশকে এর প্রায় ১৯ টি যাত্রা বাতিল করতে হয়। আবার এই ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার অবসান হওয়ার পর বিমান বাংলাদেশ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই অতিরীক্ত যাত্রীর জন্য অতিরীক্ত বিমান যোগাড় করতে ব্যার্থ হয়।
২০০৭ সালে বিমানের হজ্জ্ব ফ্লাইটের সমস্যা সমাধানের জন্য সাবেক তত্বাবধায়ক সরকার তিন বছর মেয়াদী পরীকল্পনা গ্রহন করে। এই পরীকল্পনা অনুসারে বাংলাদেশের অন্য দুটি আন্তর্জাতীক বিমানবন্দর শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেও হজ্জ্ব ফ্লাইট পরীচালনা শুরু হয়। বিমান বাংলাদেশ হজ্জ্ব ফ্লাইট পরীচালনার জন্য ফুকেট এয়ার থেকে দুটি বিমান লিজ নেয়। ফুকেট এয়ারকে চুক্তি অনুযায়ী ১০% অগ্রীম দেওয়ার কথা থাকলেও তারা ৩০% অগ্রীম দাবি করে বসলে ২০০৭ সালের আগষ্ট মাসে এই চুক্তি শেষ হয়ে যায়। ফুকেট এয়ারের জায়গা পূরন করতে একটি রি-টেন্ডারের মাধ্যমে অষ্ট্রেলিয়ার আসবান এরোনেটিক্সকে পরবর্তীতে নির্বাচন করা হয়।
২০১২ সালের আগস্ট মাসেও বিমান হজ্ব ফ্লাইট নিয়ে একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়। বিমান এর হজ্ব ফ্লাইট সময়সূচী ঠিক রাখতে গিয়ে অন্যান্য গন্তব্যসমূহে অনিয়মিত হয়ে পরে। তা সত্বেও বিমান হজ্ব ফ্লাইট পরিচালনা করে প্রায় একশ কোটি টাকা লাভও করে যা বিমানের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। ২০১৩ সালে হজ্ব ফ্লাইটগুলো কিছুটা বিলম্বিত হলেও অন্যান্য বছরের তুলনায় যাত্রীদের দূর্ভোগ কিছুটা কমই হয়েছে। এছাড়া ২০১৪ সালের হজ্ব ফ্লাইটে আরও দুটি ফ্লাইট যোগ করার কথা জানায় বিমান কর্তৃপক্ষ।
প্রতীক
আধুনিক বাংলায় বিমান শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ “ভিমান” থেকে। প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে “ভিমান” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে এমন একটি যন্ত্র বোঝাতে যা উড়তে পারে। বিমানের প্রাতীক হিসেবে লেজে লাল বৃত্তের ভিতরে সাদা বলাকা অঙ্কিত চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। তবে শুরুর দিকে বিমানের নাক থেকে শুরু করে জানালার উপর দিয়ে লেজ পর্যন্ত একটি গাড় লাইন বিমান বাংলাদেশের প্রতীক ছিল এই গাড় সবুজ লাইনটি আশির দশকে পরিবর্তন করে বাংলাদেশের পতাকার সাথে মিলিয়ে লাল ও সবুজ রঙ ব্যবহার করা হয় যা পরবর্তীতে দুই দশক ধরে টিকে ছিল। ২০১০ সালে বিমান বাংলাদেশ একটি বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার ফলে এর সবধরনের প্রতীকেই পরিবর্তন আনা হয়। একই বছর বিমানের নতুন প্রতীক উন্মোচন করা হয় এবং ভাড়ায় আনা বোয়িং ৭৭৭ বিমানে তা প্রথমবারের মত ব্যবহার করা হয়। তবে নির্বাচনের পরে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসলে বিমানকে তার পুরোনো প্রতীকে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয় কারণ সেই সরকার বিমানের এই ব্র্যান্ডিং কোনভাবেই পছন্দ করে নি। এর পরীপ্রেক্ষিতে বিমান একটি আধুনিক প্রতীক সংযোজন করে যা প্রথম বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর বিমানে প্রদর্শিত হয়। বর্তমানে বিমান বাংলাদেশের বিমানগুলো এই তিন ধরনের প্রতীকই ব্যবহার করে আসছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সদর দফতরের নাম রাখা হয়েছে বলাকা ভবন যা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত।
বর্তমান বহর
এপ্রিল ২০১৮ পর্যন্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স নিম্নোক্ত বিমানসমূহ দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করছে
আমাদের অফিসের ঠিকানা
এয়ারওয়েজ অফিস, হ্যাপি আর্কেড শপিং মল, তৃতীয় তলা, ৩৪ নম্বর সুট, ৩ নাম্বার রোড, ধানমন্ডি, ঢাকা ১২০৫। মোবাইল : 0197856929 ইমেইল: airwaysoffice@gmail.com
ওয়েবসাইট: www.airwaysoffice.com