কম খরচে বিদেশ ভ্রমণের টিপস

992

কম খরচে বিদেশ ভ্রমণের টিপস

ভ্রমণবিলাস, মানবজাতির এই স্বভাবটি যেন অবিনশ্বর। অজানাকে জানার কৌতূহল কিংবা নিছক
সৌন্দর্য উপভোগ; যে কারণেই হোক না কেন, মানুষ ঘুরতে পছন্দ করে। গুটি কয়েক মানুষের জন্য তা
যেন আরো বেশি সত্যি। তাদের রক্তে মিশে আছে ভ্রমণের নেশা। দেশ-দেশান্তরে ছুটে চলার যে
উদ্দীপনা তারা অনুভব করেন তা যেন নিরন্তর তাড়া করে ফেরে তাদের। আবার অনেকেই নিছক শান্ত
শিষ্ট রীতিতে কিছু নির্দিষ্ট স্থান ঘুরতে পারলেই খুশি। তবে আপনি যেই ধরনের ভ্রমণকারীই হোন না
কেন, বিদেশে ভ্রমণ করতে হলে চাই সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা। জানা থাকা চাই বিদেশ ভ্রমণ
প্রস্তুতির আদ্যপান্ত। সে সকল তথ্য নিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের এই লেখাটি।

পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ ও পরিকল্পনা
বিদেশ ভ্রমণের পূর্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেই দুটি বিষয় সেগুলো হল তথ্য সংগ্রহ ও পরিকল্পনা।
যেকোনো স্থানে ভ্রমণের পূর্বেই সে স্থান সম্পর্কে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করা উচিত। আর যদি
ভ্রমণের স্থানটি হয় বিদেশের মাটিতে তবে তো তা আরো জরুরী। তথ্য সংগ্রহ করার মূলত দু’টি উপায়
রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমেই সাহায্য নিতে পারেন ইন্টারনেটের। সামান্য কয়েকটি গুগল সার্চের
মাধ্যমেই স্থানটি সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা পেতে পারেন। তবে সেটুকুতে সন্তুষ্ট না হয়ে
আরো সার্চ করুন, একাধিক সাইটের রিভিউ পড়ুন, একাধিক ব্লগারের ভিডিও দেখুন। পর্যাপ্ত সময়
দিলে শুধু ইন্টারনেটের সাহায্যেই জানতে পারবেন অনেক কিছু।
এবার দ্বিতীয় ধাপের পালা। ঐ স্থানটিতে আগেই ভ্রমণ করেছে এমন কারো সাথে যোগাযোগ করুন।
তার সাথে কথা বলে জেনে নিন ক্ষুদ্র বিষয় গুলো। এমন কাউকে না পেলে আবারো দ্বারস্থ হতে হবে
ইন্টারনেটের। দেশি কোন ট্রাভেল গ্রুপে পোস্ট দিয়ে সেখানে আগে ভ্রমণ করেছে এমন কাউকে
খোঁজার চেষ্টা করুন। এভাবে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ হওয়ার পরে ঠিক করুন যে বছরের কোন সময়টিতে
আপনি যাবেন। কোন সময়ে আবহাওয়া মোটামুটি ভাল থাকবে ও টুরিস্টের চাপ খানিকটা কম থাকবে।
মনে রাখবেন, বিদেশ ভ্রমণের অন্তত ৩ মাস আগে থেকে প্রস্তুতি শুরু করতে হবে। আর যদি এটি
আপনার প্রথম বিদেশ যাত্রা হয় তবে ৬ মাসও লাগতে পারে।

ট্রাভেল এজেন্সির সাহায্যে ভিসা প্রস্তুত করা
পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়া বিদেশ ভ্রমণের চিন্তা অলীক স্বপ্ন মাত্র। বাংলাদেশে বর্তমানে ই-
পাসপোর্টের প্রচলন শুরু হয়ে গিয়েছে। ই-পাসপোর্ট এর আবেদন এর পর সবকিছু ঠিক থাকলে ২০/২৫
দিনের মদ্ধে আপনার পাসপোর্টটি পেয়ে যাবেন আর যদি কোন ভুল করে থাকেন তাহলে একটু সময়
লাগতেই পারে। এজন্য নতুন ই-পাসপোর্ট এর আবেদন করার নিয়ম কানুন গুলো আগে থেকেই জেনে
নিন। তাহলে ভুল হওয়ার সম্ভবনা থাকবে না এবং খুব দ্রুতই হাতে পেয়ে যাবেন। পাসপোর্ট তৈরির

হওয়ার পরে যে দেশে যাবেন তার ভিসা যোগাড় করতে হবে। বাংলাদেশের পাসপোর্টের ক্ষমতা অনুযায়ী
পৃথিবীর মোট ৪১টি দেশে ভিসা ছাড়া যাওয়া যায় অথবা পৌছানোর পরে ভিসা পাওয়া যায়। কিন্তু বাকি
দেশ গুলোতে ঘুরতে আপনার ভিসা প্রয়োজন। ভ্রমণজনিত ভিসা পেতে অনেক ট্রাভেল এজেন্সি
আপনাকে নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে সাহায্য করবে। কিন্তু কোন ট্রাভেল এজেন্সির সাহায্যে ভিসা
করাবেন তা কিছুটা যাচাই বাছাই করে ঠিক করুন। পরিচিতজনের মতামত ও অন্য গ্রাহকদের
অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে আপনার জন্য সেরা প্রতিষ্ঠানটি চিহ্নিত করুন।

বাজেট তৈরি
বিদেশ ভ্রমণের পরিকল্পনায় যেই বিষয়টি সবচেয়ে জরুরী তা হল বাজেট তৈরি। সুপরিকল্পিত বাজেট
ছাড়া আপনি অনাকাঙ্খিত ভাবে বিশাল অংকের টাকা খরচ করে ফেলতে পারেন। যা বিদেশের মাটিতে
আপনাকে ভয়াবহ বিপদে ফেলার জন্য যথেষ্ট। বাজেট তৈরিতে যেসব বিষয় আমলে আনতে হবেঃ
পূর্ববর্তী খরচঃ
● পাসপোর্ট, ভিসা ও ট্রাভেল এজেন্সি ফী।
● ব্যাগ, সুটকেস ও মানানসই কাপড়।
● ঔষধ ও প্রসাধন সামগ্রী।
● গাইডবই এবং সময় কাটানোর বই।
● ট্রাভেল ইন্সুরেন্স।
● ক্যামেরা ও অন্যান্য গিয়ার (অনাবশ্যক)।
যাতায়াত খরচঃ
● বিমান ভাড়া।
● এয়ারপোর্ট পার্কিং ও লাগেজ ফী।
● ট্রেন, বাস, অটো, গাড়ি ও অন্যান্য যানবাহনের ভাড়া।
খাবার ও থাকার খরচঃ
● হোটেল/লজ/ফার্ম ভাড়া।
● ভারী ও হালকা খাবারের খরচ।
অন্যান্য খরচঃ
● মিউজিয়াম টিকেট, কনসার্ট অথবা বিশেষ স্থানে প্রবেশের টিকেট।
● স্কুবা ডাইভিং, বাঙ্গি জাম্পিং, প্যারা সেইলিং ইত্যাদি উত্তেজক অভিজ্ঞতার টিকিট।
● ফিরতি উপহার, লন্ড্রি, ব্যাংক চার্জ ও অন্যান্য।

এছাড়াও অনাকাঙ্খিত নানা খরচের জন্য প্রাথমিক বাজেটের অন্তত ১৫-২০% অর্থ যোগ করে মূল
বাজেট তৈরি করা উচিত। বাজেট তৈরির পরেই টাকা জমানো শুরু করুন। কারণ টাকার পরিমাণ বাজেটের
বেশি বই কম হওয়া চলবে না।

হোটেল বুকিং
বর্তমানে অনলাইনেই সারা বিশ্বের অসংখ্য হোটেল বুক করা সম্ভব। আপনি যেসব স্থান গুলো ভ্রমণ
করবেন অনলাইনে সেসব স্থানের হোটেল গুলো দেখে নিন। পর্যটক আকর্ষণী স্থান হলে অতি
অবশ্যই আগে থেকে হোটেল বুক করুন। এক্ষেত্রে হোটেল গুলোর রিভিউ এর উপরে নির্ভর করে
আপনার সিধান্ত নিতে হবে। তবে খরচ কমাতে চাইলে হোটেলে না থেকে লজ (Lodge) বা মোটেল
(Motel) এও থাকতে পারেন। উন্নত দেশ গুলোতে হোটেলের তুলনায় এসব আবাসস্থলে খরচ অনেক
কম। আবার ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশে অনেক চাষী বা বাড়ির মালিক
কম খরচে বাড়ির একটি বা দু’টি ঘর ও ভাড়া দিয়ে থাকেন। খরচ কমাতে চাইলে এসব দিকও খতিয়ে
দেখতে পারেন।


টিকেট বুকিং
হোটেল বুকিং এর মতই টিকেট বুকিংও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টুরিস্ট সিজন শুরু হওয়ার আগেই
প্লেনের টিকেট বুক করে রাখুন। এক্ষেত্রে ক্যালেন্ডার দেখে হিসাব করুন কোন স্থানে কতদিন
থাকবেন। প্লেনের টিকেটের পাশাপাশি সম্ভব হলে অনলাইনে ট্রেনের টিকিট বুক করুন। অনেকে পুরো
ভ্রমণ গাড়িতেই শেষ করতে চান। কিন্তু খরচ কমাতে চাইলে গণপরিবহনই একমাত্র ভরসা।

আর্ন্তজাতিক ক্রেডিট কার্ড
বিদেশের মাটিতে আপনার সবচেয়ে বড় বন্ধু হল আপনার ক্রেডিট কার্ড। নগদ টাকা সাথে করে বিদেশ
ভ্রমণের দিন অনেক আগেই শেষ। টাকা নিরাপদে রাখতে চাইলে ক্রেডিট কার্ডের সাহায্যে লেনদেন
করুন। তবে সাধারণ ক্রেডিট কার্ড বিদেশে আপনার কোন চাহিদাই পূরণ করতে পারবে না। বিদেশে
ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা নিতে দেশ ছাড়ার পূর্বেই কার্ডটি পাসপোর্টের সাহায্যে এনডোর্স
(Endorse) করান। ভিসা বা আমেরিকান এক্সপ্রেস কার্ডে পর্যাপ্ত মার্কিন ডলার জমা করে নিলেই
তা পুরো ভ্রমণ জুড়ে ব্যবহার করতে পারবেন। তবে কোন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করবেন
তা সাবধানতার সাথে নিশ্চিত করুন। এ ব্যাপারে অন্যান্য ব্যবহারকারীদের পরামর্শ অবশ্যই নিন।
কারণ কারিগরি জটিলতার কারণে আপনার ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন বন্ধ হয়ে গেলে ভয়াবহ বিপদে
পড়বেন। তাই অকুল পাথারে না পড়তে চাইলে ঝামেলাবিহীন ক্রেডিট কার্ড তৈরি করুন। সবচেয়ে ভাল
হয় অন্তত ২ থেকে ৩টি কার্ড সাথে রাখলে।

সুবিধাজনক হারে ডলার বিনিময়

বিদেশ ভ্রমণের সময় ডলারের বিনিময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আর্ন্তজাতিক নানা কারণে
ডলারের মান অনেক সময়ই কিছুটা বেড়ে যায়। তাই বিদেশে পৌছেই সমস্ত ডলার ঐ দেশের মুদ্রায়
পরিবর্তন করে নেওয়া তেমন বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বিশেষত এয়ারপোর্টের সাথেই যেসব মানি
এক্সচেঞ্জ (Money Exchange) প্রতিষ্ঠান গুলো থাকে তারা প্রায়শই প্রচলিত দরের চেয়ে কম
দরে ডলার বিনিময়ের চেষ্টা করে। অর্থাৎ প্রথম বারেই সকল ডলার বিনিময় একেবারেই অনুচিত।
সিম কার্ড কেনা, ট্যাক্সি ভাড়া ইত্যাদির জন্য খানিকটা ডলার ভাঙিয়ে বাকিটা পরে বিনিময় করলেই
সবচেয়ে ভাল হয়।

কম মালপত্র বহন
অনেক কাল আগে যখন মানুষ জাহাজে করে দেশ ভ্রমণ করতো, তখন তাদের লটবহর ছিল দেখার মত।
কিন্তু দিন বদলেছে, তার সাথে বদলেছে বিদেশ ভ্রমণের নিয়ম কানুন। বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে এখন
যতটা কম মালপত্র বহন করা যায় ততইটাই ভাল। একেবারেই না হলেই নয় এমন জিনিসই বহন
করবেন। কারণ এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়ার সময় মাল যত বেশি থাকবে, যাতায়াতের
ঝামেলা ও খরচ ততটাই বাড়বে। তাই যথাসম্ভব ঝাড়া হাত-পা নিয়ে ভ্রমণ করুন।

ট্রাভেল ইন্সুরেন্স
বাংলাদেশের মাটিতে ট্রাভেল ইন্সুরেন্স বস্তুটির অতটা চল না থাকলেও অনেক উন্নত দেশেই এটি
বাধ্যতামূলক। সত্যি বলতে বাধ্যতামূলক না হলেও ট্রাভেল ইন্সুরেন্স করাটা বেশ ভাল একটি
সিধান্ত। কারন বিদেশ-বিভূঁই এ ঘটতে পারে নানা বিপদ। হটাৎ অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন, মালপত্র
হারাতে পারে, শেষ মুহূর্তে যাত্রা বাতিল হতে পারে। এমন নানা সমস্যা এড়াতে ইন্সুরেন্স করে রাখাটা
আর্ন্তজাতিক ভ্রমণের শিষ্টাচারের মধ্যেই পড়ে।

অন্যান্য বিষয়াবলী
উপরিউক্ত বিষয়াবলীর পাশাপাশি আরো বেশ কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত। তার মধ্যে অন্যতম হল
স্থানীয় ভাষা শিক্ষা। ভাষাটা পুরোপুরি শিখে নেওয়াটা অনেকাংশেই অসম্ভব বলা চলে। তবুও
ইন্টারনেটের সাহায্যে ভাষার সাধারণ কিছু শব্দ ও বাক্য সম্পর্কে ধারণা নেওয়াটা আবশ্যক।
প্রয়োজনীয় ঔষুধ, মোবাইলের পাওয়ার ব্যাংক ইত্যাদি সঙ্গে রাখাটাও জরুরী। এছাড়াও কোথায় কখন
যাচ্ছেন কিংবা যাবেন তা সার্বক্ষণিক গুগলের লোকেশন হিস্ট্রিতে সংরক্ষণ করে রাখুন। ফলে কোন
বিপদ হলেও আপনার আপনজন ঘরে বসেই বুঝতে পারবে যে আপনি সর্বশেষ কোথায় ছিলেন।

শেষকথা
ভ্রমণের নেশা মানবগোষ্ঠির যেন এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তবে ভ্রমণের নেশায় শুধু ছুটলেই হবে না,
তার আগে চাই সঠিক পরিকল্পনা। আশা করি এই লেখাটি আপনাদের বিদেশ ভ্রমণের পূর্ব-
পরিকল্পনাকে আরো নিখুঁত করে তুলবে।