কোন দেশের ইতিহাস,ঐতিহ্য,সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার সব থেকে সহজ মাধ্যম হল সেই দেশের জাদুঘরে ভ্রমণ করা। প্রতিটি দেশ তার ইতিহাস,ঐতিহ্য,সংস্কৃতি জাদুঘরের মাধ্যমে মানুষের সামনে তুলে ধরে। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলেই তেমনি জাদুঘর রয়েছে। সেই সকল জাদুঘরে বাংলার ইতিহাস,ঐতিহ্য,সংস্কৃতির প্রমান সহ নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের সকল জাদুঘরের মধ্যে অন্যতম একটি হল পঞ্চগড় জেলার রক্স জাদুঘর। জাদুঘরের গ্যালারিতে কাঁচের মধ্য থরে থরে রাখা বিভিন্ন প্রজাতির পাথর ও নানা দুর্লভ সংগ্রহ। তিনশ’ থেকে দুই হাজার বছরের পুরনো ইমারতের ইট-পাথরের মূর্তি এবং পোড়ামাটির নকশা। দর্শনার্থীরা মুগ্ধ চোখ দেখছেন এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন। এমন সব দুর্লভ সংগ্রহের এক মূল্যবান সূতিকাগার হয়ে উঠেছে সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে অবস্থিত দেশের একমাত্র রকস্ মিউজিয়াম বা পাথরের জাদুঘর।
এখানকার ভূভাগে রয়েছে প্রচুর নুড়ি পাথর। ভূগর্ভের নুড়ি পাথরের কালানুক্রমিক নমুনা নিয়ে পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজে এ মিউজিয়াম গড়ে তোলা হয়েছে। ভূখণ্ডের বয়স নির্ণয়, ভূমির বৈশিষ্ট্য, প্রাগৈতিহাসিক নমুনা সংগ্রহ, নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ ও গবেষণার জন্য কলেজেটির প্রাক্তন অধ্যক্ষ ড. নাজমুল হক ১৯৯৭ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ মিউজিয়াম গড়ে তোলেন।
এ মিউজিয়ামে অভ্যন্তরীণ ও উম্মুক্ত দুই রকমের গ্যালারি রয়েছে। অভ্যন্তরীণ গ্যালারিতে রয়েছে -বিভিন্ন আকৃতির রং ও বৈশিষ্ট্যের আগ্নেয়শিলা, পাললিক শিলা ও নুড়ি পাথর, সিলিকা, নুড়ি ও সিলিকা বালি, হলুদ ও গাঢ় হলুদ রঙের বালি, খনিজ বালি, সাদা মাটি, কুমার মাটি এবং কঠিন শিলা, সামুদ্রিক ঝিনুক, শঙ্খ, মৃৎপাত্র, প্রাচীনকালে মাটির কূপের জন্য ব্যবহৃত রিং, বৃটিশ আমলে ব্যবহৃত মাইলস্টোন।
এ গ্যালারিতে একটি জাতিতাত্ত্বিক সংগ্রহশালাও স্থাপন করা হয়েছে। এখানে রয়েছে এ অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। আছে তিনশ’ থেকে দুই হাজার বছরের পুরনো ইমারতের ইট-পাথরের মূর্তি এবং পোড়ামাটির নকশা। এছাড়াও রয়েছে এ অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যবহৃত কাচিয়া, কাত্তি, ফুতি, খরম, টপুনি, তাড়ি, ঘোট, কিয়া, সিঁদুর দানি।
রয়েছে কালনাগ, মনসার পিতলের মূর্তি, বিষহরির মূর্তি, বিষ্ণু-গণেশের মূর্তি, ধাতবপাত্র, প্রদীপ, পঞ্চপ্রদীপ, কুঠি (কাঁশ দিয়ে তৈরি), টার শিকিয়া, অশ্মীভূত পিঁপড়ার বাসা, হুলির গানে ব্যবহৃত ঢোল, হিন্দু আদিবাসীদের ব্যবহৃত বিয়ের ডালা, প্রবাল পাথর, একতারা, পাথরের সেতুতে ব্যবহৃত আয়ুধ, সাকামচুকি (সাঁওতালদের ব্যবহৃত বিড়ি বিশেষ), তীর-ধনুক, মোঘল সৈনিকদের ব্যবহৃত তরবারি, পাথরের বাটি, জীবজন্তু ও ফুলের নকশা উৎকীর্ণ বাঁশের বেড়া, রাজমহল পাহারের কালো পাথর, বিভিন্ন প্রাচীন মুদ্রাসহ দুর্লভ সব সংগ্রহ।
এখানে ‘বায়ান্ন থেকে বাহাত্তর’ শিরোনামে একটি ফটো গ্যালারিও রয়েছে। মিউজিয়ামের মূল ভবনের ভেতরেই রয়েছে প্রায় তিনশ’ বছরের প্রাচীন দুটি নৌকা। একটি শালগাছ কেটে মাঝখানে খোদাই করে বিশাল আকৃতির নৌকা দুটি তৈরি। নৌকা দুটির দৈর্ঘ্য ২২ ফুট ৬ ইঞ্চি। এ ধরণের নৌকা প্রাচীনকালে আদিবাসীরা প্রশান্ত মহাসাগরের দীপপুঞ্জে ব্যবহার করতো বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।
উন্মুক্ত গ্যালারিতে রয়েছে বিশাল আকৃতির বেলে পাথর, গ্রানাইট পাথর, কোয়ার্জাইট ব্যাসল্ট, শেল-মার্বেল, বিভিন্ন নামের ও বর্ণের শিলা, সিলিকায়িত কাঠ বা গাছ থেকে রূপান্তরিত পাথর। এসব পাথর প্রথমবার দেখলে যে কেউ বিস্মিত হতে পারেন। শত শত বছর মাটির নিচে থাকার পর এসব গাছের গুড়ি পাথরে রূপান্তর হয়েছে।
রয়েছে নকশা করা অলঙ্কৃত খিলান ও বিভিন্ন রেখা, রেখা ও চিত্রাঙ্কিত শিলা এবং পাথর ও লোহা মিশ্রিত মাটি লোহাকাঁচি। প্রাচীনকালে রাজা মন্ত্রীরা বসতেন এমন পাথর, প্রস্তর খণ্ড (প্রস্তর সেতুতে ব্যবহারের জন্য), চাইনিজ বর্ণ অঙ্কিত পাথর, ১৪ শত বছর পূর্বে এ অঞ্চলের পৃথু রাজা ভবনে ব্যবহারের জন্য এক ধরণের স্লাব তৈরি করতেন। সেই পাথরও রয়েছে এখানে। এসব পাথর খোদাই করে ভবন নির্মাণ করা হতো।
কিভাবে যাওয়া যায়:
পঞ্চগড় কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে রিক্সাযোগে পঞ্চগড় সরকারী মহিলা কলেজ। পঞ্চগড় সরকারী মহিলা কলেজে রকস্ মিউজিয়ামটি অবস্থিত।