বরিশাল ভ্রমণ| ট্র্যাভেল নিউজ বাংলাদেশ

1600

সাঁতার জানিনা বলে সমুদ্র কিংবা নদীতে যাওয়া হয়না খুব একটা। পরিবার থেকে কখনই নদীপথে ভ্রমণের অনুমতি পাওয়া যায় না। কিন্তু কেন যেন নদী, সমুদ্র সব সময়ই কাছে টানে, চুম্বকের মত আকর্ষণ করে। ২০১৩ সালের শেষ দিকে অনেকটা ঝোঁকের বশে সন্দীপ গিয়েছিলাম। তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত ছিল। তবে নদীপথে হরতাল অবরোধের প্রভাব পড়ে না বললেই চলে। আর নদীপথে ভ্রমণ খুবই আরামদায়ক হওয়ায় অনেকেই সড়কপথের তুলনায় এটাকেই বেশি পছন্দ করে।

বাংলাদেশের চারটি বিভাগ, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট আর রাজশাহীতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আগেই। বরিশাল আর খুলনা বিভাগ একই ট্যুরে ভ্রমণ করার সুযোগ তাই হাতছাড়া করলাম না। বেড়াই বাংলাদেশ এর আহবানে সাড়া দিয়ে ২০১৫ সালের ১১ জুন সন্ধ্যা ৭টায় এম. ভি. বাঙ্গালী স্টিমারে করে বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা হই আমরা ২৫ জন। স্টিমার ছাড়তে দেরি হচ্ছিল কিছুটা। জানতে পারলাম মাননীয় শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুও আমাদের ভ্রমণসঙ্গী হবেন। ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিট দেরি করে ছাড়ল স্টিমার। তবে বেশ দ্রুত গতির নৌযানটি সময়মতোই বরিশাল পৌঁছায়। আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল ডেকে। আমাদের সঙ্গে ছিলেন দুইজন বিদেশী মেহমান, বিশ্বব্যাংকের দুইজন কর্মকর্তা। তাদের জন্য কেবিনের ব্যবস্থা ছিল, আমাদের মধ্যে কয়েকজনের জন্য কেবিনের ব্যবস্থা হয়েছিল। আমি ঘুমিয়েছিলাম ডেকে, মেঝেতে চাদর বিছিয়ে। অবশ্য অনেক মানুষ যখন পাশাপাশি ঘুমিয়ে থাকে তখন পরিবেশ একটু গরম হয়ে ওঠে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। স্টিমার যখন চাঁদপুরে পৌঁছল তখন আরও অনেক বেশি মানুষ উঠে পড়ল ডেকে। পা ফেলার জায়গা পেতেও তখন সমস্যা হচ্ছিল। রাতের খাবারটা ছিল বেশ ভাল। খিচুড়ি আমার খুব প্রিয়। সাথে ডিম আর মুরগীর গোশত। আমার সঠিক সময়ে ঘুমানোর অভ্যাস তাই অন্যদের সাথে এসি ডাইনিং রুমে বসে সময় কাটানো হল না। সবাই সারারাত আড্ডা দিয়ে অনেক মজার সময় কাটিয়েছিল। চাঁদপুরের মোহনায় নাকি স্টিমার প্রচন্ডভাবে দুলছিল। ঘুমের মধ্যে আমি সেই রোমাঞ্চকর মুহূর্তগুলো মিস করলাম। তবে ঘুম থেকে উঠলাম খুব সুন্দর একটা সময়ে। উপরের ডেকে ফজরের নামাজ আদায়ের পর স্টিমারের সামনে যে জায়গায় সবচেয়ে বেশি বাতাস সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। সাথে ছিলেন সাজ্জাদ ভাই (যার মাধ্যমে বেড়াই বাংলাদেশের সাথে আমার পরিচয়)।

কীর্তনখোলা-২ (বরিশাল-ঢাকা রুটের লঞ্চ)

স্টিমারে উঠেই ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। বরিশাল লঞ্চ ঘাটে পৌঁছে বড় বড় সব স্টিমার দেখে বেশ অবাক হলাম। এত বিলাসবহুল সব লঞ্চ এই রুটে চলাচল করে তা জানতাম না। লঞ্চ ঘাটে পৌঁছে আবার একটা স্ট্যাটাস দিলাম। সিলেটে আর দেশের বাইরে আমার আত্মীয়-স্বজনেরা দুশ্চিন্তায় থাকবেন তাই ঘনঘন স্ট্যাটাস দেওয়া। লঞ্চঘাট থেকে আমরা ছোট ছোট ব্যাটারীচালিত ইজিবাইকে ৪/৫ জন করে নগরীর কাটপট্টি রোডে অবস্থিত হোটেল অ্যাথেনা ইন্টারন্যাশনাল (Hotel Athena International) এ পৌঁছুলাম। খানিকটা দেরি হয়ে গেল আমার কারণ অামার দায়িত্বে ছিল আমাদের পুরো গ্রুপ (সাজ্জাদ ভাই, সোমা ভাবী, অমিয়া, সাইফুল ভাই) এর লাইফ জ্যাকেটগুলো। আমি আরও ২ জন ভাইয়ার সাথে একটা রুমে সেট হলাম। সেখানে পরিচিত হলাম আমার বিসিআইসি কলেজের এক সিনিয়র ভাই, রাজন ভাইয়ার সাথে। আরও ছিলেন রুবাইয়াত মাসরুর মারূফ, অসাধারণ প্রাণোচ্ছল বিক্রমপুরের একজন ভ্রমণবিলাসী মানুষ।

ঝটপট গোসল সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম স্বরূপকাঠীর উদ্দেশ্যে। সকালের নাস্তা সেরে নিলাম কে. বি. হেমায়েত উদ্দিন রোডের আকাশ হোটেল এন্ড রেস্তোরায়। রাতে এম. ভি. বাঙালীর খিচুরীর পর সকালের খিচুরী নিয়ে একটু গড়িমসি করলেও আমি মনে মনে প্রচন্ত খুশি হলাম (কারণ আমি বছরের ৩৬৫দিন খিচুরী খেতে কোন আপত্তি করব না)। শুরু হল স্বরূপকাঠী যাওয়ার আয়োজন। ইজিবাইকে করে আমরা গেলাম নথুল্লাবাদ বাস স্ট্যান্ডে। ইজিবাইকের চালকের পাশে বসে একটা সুবিধে হল। তিনি বরিশাল শহরের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রাস্তা থেকে দেখিয়ে দিলেন। আমরা জেলখানা রোড দিয়ে বরিশালের বিখ্যাত ব্রজমোহল কলেজ (বি. এম. কলেজ) অতিক্রম করে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছুলাম। বাস পেতে খানিকটা দেরি হল। এই ফাঁকে বাস স্ট্যান্ডের সfমনে থাকা একটা পরিত্যক্ত রোলার এর উপর উঠে চলল ফটোসেশন। আমাদের গন্তব্য স্বরূপকাঠী-বরিশাল রোড হয়ে বানাড়ীপাড়া পুলিশ স্টেশন। পরিকল্পনা ছিল নদীর পাড় থেকে ছো্ট্ট ইঞ্জিনচালিত বোটে করে স্বরূপকাঠীর পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ানো। ঘাটে পৌঁছে আমরা ঝটপট লাইফ জ্যাকেট পরে নিলাম। আমার জীবনে প্রথম লাইফ জ্যাকেট পড়ার অভিজ্ঞতা। তবে আর অনেকের জন্যই প্রথম, যেমন আমাদের সর্বকনিষ্ঠ ভ্রমণকারী জাফনাহ নাওয়ার অমিয়ারও প্রথমবার।

স্রষ্টা কোন অপূর্ণতা রাখেননি স্বরূপকাঠীর প্রকৃতিতে। ব্যক্তিগতভাবে আমি আশেপাশের প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে থাকলাম। আমাদের সাথে ছিল তিনটি ডিএসএলআর ক্যামেরা, একজন পেশাদার, দু‘জন অপেশাদার আলোকচিত্রশিল্পী। তাছাড়া সবার হাতের স্মার্টফোনগুলো কযেক মুহূর্ত পরপরই সক্রিয় হয়ে উঠছিল। কখনও কখনও চ্যানেলগুলো এত সরু হয়ে যাচ্ছিল যে, আমরা খুব সহজেই পাড়ে থাকা গাছ থেকে আমড়া পেড়ে নিয়ে খেতে শুরু করি। ভ্রমণের শুরুতেই আমরা বাস্তকাঠী নামে একটি গ্রামে খালের চ্যানেলের উপর তৈরি অসংখ্য সাঁকোর একটার নিচে নৌকা ভিড়িয়ে নেমে পড়ি। স্থানীয় এক কৃষক নৌকায় করে কলা, কাঁঠাল নিয়ে হাটে যাচ্ছিলেন। আমরা সবাই কলা আর কাঁঠাল খেতে শুরু করলাম। ইতিমধ্যে জলে নেমে পড়েছেন মাহমুদ ভাই, মারূফ ভাই, শিরিন আপু, ইয়াসিন ভাই। সাঁকোর উপরে চলতে লাগল ফটোসেশন। মাহমুদ ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম স্বরূপকাঠী বাংলাদেশে বিভিন্ন নার্সারীতে প্রাপ্ত চারার একটা বিরাট অংশ সরবরাহ করে থাকে। এখানকার মানুষগুলো প্রচন্ত পরিশ্রমী। পেশায় পুরদস্তুর কৃষক অথবা জেলে।

একপর্যায়ে আমরা ঝালকাঠির একটি গ্রামে পৌঁছে গেলাম। সেখানে সবাই মিলে প্রচুর পরিমাণে পানিফল (Water Caltrop) খেলাম। সবাই বেশ ক্ষুধার্ত ছিল তা বেশ বুঝা গেল। ভীমরুলী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে টিউবওয়েল থেকে পানি পান করতে খুব ভাল লাগল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর আমরা আটঘরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর বৃষ্টি প্রথমবারের মত বাধ সাধলো। তবে বোট ঘুরিয়ে নেওয়ার আগেই আমরা মুখোমুখি হলাম অসাধারণ এক দৃশ্যের। পেয়ে গেলাম একটা নৌকার হাট। ততক্ষণে কিন্তু সূর্য পশ্চিমদিকে বেশ খানিকটা হেলে পড়েছে। সবাই ক্ষুধার্ত। তাই দেরি না করে আমরা কুড়িয়ানা (নেছারাবাদ, পিরোজপুর) বাজারে গিয়ে উঠলাম মধ্যাহ্নভোজনের জন্য। ছো্ট্ট একটা হোটেল, নাম সকাল সন্ধ্যা হোটেল। সত্ত্বাধিকারী বরুণ সিকদার আর তার স্ত্রী নিজেরাই খাবার পরিবেশন করছিলেন। কি অসাধারণ সে খাবার তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। পুঁইশাক, বেগুন ভাজা, মাছ আর মুরগীর প্রিপারেশন।

খাওয়ার পর পরিতৃপ্ত অবস্থায় যখন হোটেল থেকে বেরিয়ে আসলাম তখন ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা কজন যোহরের কছর নামায আদায়ের জন্য মসজিদ খুঁজতে লাগলাম। মসজিদ পেতে বেশ খানিকটা দেরি হল। ছোট একটা টিনের মসজিদে আমরা যোহর আর আছরের কছর নামাজ একসাথে আদায় করে ফিরলাম। নৌকা তখন আমাদের অপেক্ষায়। আমরা বরিশাল শহরে ফিরে যাব। করিৎকর্মা বোটের চালক আমাদের মূল সড়কের কাছাকাছি পয়েন্টে নামিয়ে দিলেন আধঘণ্টা পর। ততক্ষণে আমাদের রিজার্ভ বাস এসে পৌঁছেনি। একটা বড় মাঠের পাশে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম। পাশের একটি বাড়ির শিশুদের কাছ থেকে ফুটবল ধার নিয়ে খেলতে নেমে গেলেন সোহাগ ভাই, আরিয়ান ভাই, মারুফ ভাই। তারপর ডেইলি স্টারের আঞ্চলিক ফটোগ্রাফার আরিফ ভাই আমাদের কয়েকটা দলগত ছবি তুলে দিলেন।

বাস চলে আসল কিছুক্ষণের মধ্যেই। গন্তব্য শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের স্মুতিঘেরা চাখার। চাখারে আমরা শেরে বাংলা স্মৃতি জাদুঘর, চাখার বাজার আর বরেণ্য এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ত্বের নামে গড়ে ওঠা বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখলাম। শের-ই-বাংলা স্মৃতি জাদুঘর, চাখার, বরিশাল সরকারী ফজলুল হক কলেজ চাখার ফজলুল হক ইন্সটিটিউশন এরপর আমরা কাছাকাছি একজন ভাইয়ার বাড়িতে ডাব খেলাম। বিশাল গৃহস্থ বাড়ি। সব ধরনের ফল আর সবজির চাষ হয়। সবার জন্য গোটা তিরিশেক ডাব যেন মুহূর্তে হাজির হয়ে গেল। সাথে আম। অসাধারণ আতিথেয়তা পর্ব শেষ হলে আমরা ছুটলাম বিখ্যাত দীঘি দুর্গাসাগর দেখতে। পথিমধ্যে উজিরপুরের বিখ্যাত বায়তুল অামান জামে মসজিদ কম্পাউন্ডের সামনে কিছুক্ষণ যাত্রাবিরতি দেওয়া হল। ব্যক্তিগত মালিকানার মসজিদ কমপ্লেক্সটিতেও প্রচুর দর্শনার্থী। বায়তুল আমান জামে মসজিদের সুউচ্চ মিনার মসজিদের ভেতরের কম্পাউন্ড প্রায় সন্ধে হয়ে আসছিল। আমরা বেশ দ্রুত মাগরিবের একটু আগে দুর্গাসাগরে এসে পৌঁছুলাম। আমি একটি বিষয়ে দারুণ অবাক হলাম। পাশেই একটা ছো্ট্ট মসজিদের নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন মুসল্লীরা। কিছু মুসল্লী ওযু করছেন দুর্গসাগরের ঘাটে। ওখানকার মানুষ কতটা অসাম্প্রদায়িক তা সম্ভবত উদাহরণ দিয়ে বুঝানোর প্রয়োজন নেই।

দুর্গাসাগর খুবই সুন্দর একটা দীঘি। আলোর স্বল্পতার কারণে আমাদের ছবিগুলো পানসে হয়ে গেল। দীঘির মাঝখানে একটুখানি ডাঙা, অতিপ্রাকৃতিক লাগছিল সন্ধ্যার সেই পরিবেশটা। দুর্গাসাগরের ঠিক মাঝ বরাবর একটি অংশ তারপর আমরা হোটেল অ্যাথেনায় ফিরে গেলাম। সবাই ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবার খেতে বেরিয়েছিলাম রাত আটটার দিকে। বরিশাল শহরের বিখ্যাত বিবির পুকুর নামে যে দিঘীটা আছে তা হোটেল থেকে বেশ কাছেই ছিল। সকালেও দেখেছিলাম। সেখানে সবাই মিলে বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। তারপর পাশের একটি রেস্টুরেন্টে খেয়ে হোটেলে ফিরলাম। শেষ হল বরিশালে আমাদের একটি ব্যস্ত দিন। খাওয়ার সময় আমাদের বলে দেওয়া হয়েছিল পরের দিন বাগেরহাটে যাওয়ার জন্য ভোর সাড়ে পাঁচটায় রিপোর্ট করতে হবে। তবে সময়টা ঠিক সাড়ে পাঁচটা না ছটা তা নিয়ে একটু দোটানা থেকে যাওয়ায় পরবর্তী দিন মজার (!) একটা ঘটনা ঘটে।

প্রথম দিন বরিশালের অনেকগুলো আকর্ষণীয়, মনোমুগ্ধকর স্থান দেখে আমরা সবাই প্রচন্ত ক্লান্ত ছিলাম আর তাই রাতের ঘুমটাও ছিল গভীর। ভোর পাঁচটা বাজতেই মারূফ ভাই আমাকে আর রাজন ভাইকে ডেকে দিলেন তৈরি হয়ে নেওয়ার জন্য। আমরা দু‘জন সময়মতো তৈরি হয়ে নিলাম কিন্তু যে মারূফ ভাই ফোন করে ৫০ শতাংশ লোককে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিলেন তারই দেরি হয়ে গেল। আমি আর রাজন ভাই সময়মতো হোটেলের রিসেপশনে বসে থাকা গ্রুপের সাথে বেরিয়ে পড়ি। আমার সাথে বেশ কিছু জিনিসপত্র থাকায় পেছনে পড়ে গেলাম। হোটেলের একজন ওয়েটারকে বকশিশ দিয়ে যখনই ঘুরে দাঁড়ালাম দেখলাম সামনের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ১০ জনের গ্রুপটা উধাও। আমি দ্রুত হেঁটে মূল সড়কে গিয়ে একটি প্রাণীকেও খুঁজে পেলাম না। দোটানায় পড়ে গেলাম। হোটেলে ফিরে যাব না কারও অপেক্ষা করব? তখনই দেখলাম মুনতাসিম আর ইয়াসির আতিফ ভাই আসছেন। তখনও আমি জানতাম না ইয়াসির ভাইয়ের বাড়ি বাগেরহাটে। বাগেরহাটে আমাদের পুরো দিনের পরিকল্পনা ইয়াসির ভাইয়ের করা। তিনজন মিলে একটা ইজিবাইকে করে পৌঁছে গেলাম সেই পুরনো লঞ্চঘাটে যেখানে এম ভি বাঙালী থেকে নেমেছিলাম।

আমরা যে ছোট্ট লঞ্চটাতে উঠতে যাচ্ছিলাম সেগুলো রকেট নামে পরিচিত। লঞ্চটার অফিসিয়াল নাম পি. এস. টার্ন। ১৯৩৫ সালে নির্মিত পি. এস. টার্ন দ্বিতীয় দিনের অনেকটা সময় বৃষ্টি হওয়ায় নষ্ট হয়ে যায়। তবে সকালে বরিশাল থেকে বাগেরহাট নৌপথে যাওয়ার বিষয়টা আমরা প্রচন্ড রকম উপভোগ করি। দু:খজনক ব্যাপার ছিল আমাদের অর্ধেক টিম বরিশালেই থেকে যায় কারণ আমরা রকেটে ওঠার সাথে সাথেই রকেট ঘাট ছেড়ে যাত্রা শুরু করে। সাজ্জাদ ভাই, ভাবী আর মারূফ ভাই লঞ্চঘাট পর্যন্ত এসেও রকেট মিস করেন। পরবর্তীতে বাসে করে টিমের বাকি সদস্যরা বাগেরহাট যান এবং আমাদের আগেই হোটেলে উঠে যান। নৌপথের যাত্রা, তাও আবার ভোরবেলা! অসাধারণ কিছু মুহূর্ত পার করি আমরা। সাথে ছিলেন টিম লিডার মাহমুদ ভাই, সদা হাস্যোজ্জ্বল শিরিন আপু, ফটোগ্রাফার সোহাগ ভাই, আব্দুস সাত্তার ভাই, রাজিয়া ইয়াসমিন আপু এবং আরও অনেকেই। রকেটে উঠে কেবিনের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। আমরা একটা কেবিন পেলাম আর সেখানে আমাদের সকল জিনিসপত্র স্টক করলাম। রকেটের সামনের দিকটায় বসে অসাধারণ পরিবেশ উপভোগ করতে লাগলাম সবাই। মাহমুদ ভাই আমাদের কৃত্রিমভাবে করা এ্কটি সরু চ্যানেল দেখালেন যা নৌপথে যাতায়াতে সুবিধার্থে মানুষ মাটি কেটে তৈরি করেছে। সেই চ্যানেলের উপরই ব্রীজ যার উপর দিয়ে আমাদের টীমের বাকি সদস্যরা বাগেরহাটে যাবে।

কৃত্রিম চ্যানেলের উপর তৈরিকৃত সেতু

রকেটের যাত্রাবিরতি ছিল ঝালকাঠিতে। তখন প্রচন্ড বৃষ্টি। লোকজন একটা বাঁশের পাটাতনের উপর দিয়ে দিব্বি ওঠানামা করছে। মালামালও নামানো হচ্ছে। নদীর পাড়ের মানুষের জীবনটাই অন্যরকম। আমাদের সবার পেটে তখন প্রচন্ড ক্ষুধা। রকেটের স্পেশাল খিচুড়ির অর্ডার দেওয়া হল (জনপ্রতি ২০০/= টাকা)। পিরোজপুরের হলুয়ার হাট ছিল আমাদের গন্তব্যস্থল। সেখানে রকেট পৌঁছাবার আগেই আমরা চিকেন আর খিচুড়ি দিয়ে সেরে নিলাম অসাধারণ এক প্রাতরাশ।

হলুয়ার হাট থেকে বাগেরহাটের যাত্রাটা একটু কষ্টদায়ক হয়ে গেল। ইজিবাইকে করে আমরা গেলাম পিরোজপুর সদর বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে লোকাল বাসে বাগেরহাট। লোকাল বাসে রীতিমতো ঠেঁসে যাত্রী নিল। আমি ছিলাম একদম শেষে পাঁচ সিটের একটায়। রীতিমত চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেলাম। তবে উপরি পাওনা হিসেবে দেখে নিলাম পিরোজপুর সদরের কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বন্ধুত্ব হয়ে গেল খুলনার ছেলে রাসেলের সাথে। রাসেল আমার পাশের সিটে ছিলেন। ঢাকার ড্যাফোডিলে এমবিএ করছেন। রাসেলের কাছ থেকে জানতে পারলাম খুলনা আর বরিশালের মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে। যদিও পাশাপাশি দু‘টি বিভাগ, মানুষের চিন্তার গতিপ্রকৃতি ভিন্ন। রাসেল তার মাতৃকুলের আত্মীয়দের বাড়ি থেকে খুলনার নিজ বাড়িতে ফিরছিলেন। একটা ছাত্র সংগঠনের বেশ উঁচু পর্যায়ের নেতা হিসেবে নিজের অবস্থান জানিয়ে দিলেন।

বাগেরহাটের দশানী মোড়ে ধানসিঁড়ি হোটেলের ঠিক সামনেই বাস থেকে নামলাম আমরা। বিধ্বস্ত একটি দল। তাড়াতাড়ি করে হোটেলের দোতলায় উঠলাম। তিনটি রুম শেয়ার করতে হল প্রায় ২৫ জন মানুষকে। তবে বেশ মজা হল। বৃষ্টি তখন পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। আমরা আটকে গেলাম হোটেলের কামরায়। চলতে লাগল কার্ড খেলা। অলস সময় কাটানো। তারপর যোহরের নামাজ একসাথে আদায় করে হোটেলের রেস্টুরেন্টে খেয়ে নিলাম সবাই মিলে। রেস্টুরেন্টটা কিন্তু বেশ জনপ্রিয়। প্রচুর লোকসমাগম। খাবারের মানও বেশ ভাল ছিল।

বিকেলের দিকে বৃষ্টিটা একটু ধরে এলে আমরা বেরিয়ে পড়ি বিখ্যাত ষাট গম্বুজ মসজিদ আর হযরত খান জাহান অালী (রহ.) এর মাজারসংলগ্ন দীঘি দেখতে। পাঁচটা ইজিবাইক দু‘ঘন্টার জন্য ভাড়া নিয়ে আমাদের বাগেরহাট শহর ভ্রমন শুরু হল। যখন ষাট গম্বুজ মসজিদের কম্পাউন্ডে এসে ঢুকেছি ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। মসজিদের সংস্কার কাজ চলছে পুরোদমে। চারদিকে বাঁশের কাঠামো। ছবি তুলতে চাচ্ছিলাম কিন্তু এই অবস্থায় ছবি তোলাটা বোকামির শামিল। প্রথমেই মসজিদ সংলগ্ন জাদুঘরে বাগেরহাটের বিভিন্ন মসজিদ আর প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনগুলো সম্পর্কে ধারণা পেলাম। বাগেরহাট হল মসজিদের শহর। এখানে অনেকগুলো মসজিদ নির্মাণ করেন উলুঘ খান জাহান অালী (রহ.)। ষাট গম্বুজ, এক গম্বুজ, নয় গম্বুজ, দশ গম্বুজ মসজিদ। ষাট গম্বুজ মসজিদের ভেতরের বিশাল কলাম আর অসাধারণ প্রস্থের দেয়ালগুলো দেখে শিহরিত হলাম। নবম-দশন শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যপুস্তক থেকে কতবার যে শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। ভিডিও দেখিয়েও অনেক ক্লাস নিয়েছি এই টপিকের উপর। একটা স্বপ্ন সত্যি হল।

তারপর আমরা ষাট গম্বুজ কমপ্লেক্সের কাছেই এক গম্বুজ মসজিদ দেখলাম। পরের স্টপেজ ছিল উলুগ খান জাহানের সমাধিস্থল এবং বিরাট দীঘি যেখানে কুমির রয়েছে বলে জনশ্রুতি আছে। দীঘির পাড়ে সাজ্জাদ ভাইয়ের সাথে একটা সেলফি নিয়েছিলাম যা উপরে দেয়া হয়েছে। তারপর আমরা সবাই বাগেরহাট শহরে প্রবেশের সময় ভৈরব নদীর উপর যে সুদৃশ্য সেতু তৈরি হয়েছে তার পাড়ে একটা চমৎকার স্পটে চলে গেলাম। সবাই মিলে রসগোল্লা আর দই উপভোগ করলাম ইয়াসিন ভাইয়ের সৌজন্যে। সবাই হোটেলে ফিরে গেল কারণ রাত ৮টার বাসেই আমাদের ঢাকা ফিরতে হবে। এদিকে হোটেলে ঢুকতে যাব এমন সময় রাজন ভাই আর সাত্তার ভাই দশ গম্বুজ মসজিদ (যা আমরা দলগতভাবে দেখতে যাইনি) দেখার প্রস্তাব দিলেন। একটা ইজিবাইক আপডাউন ভাড়া নিয়ে চলে গেলাম দশগম্বুজ মসজিদ দেখতে। অন্যান্য মসজিদের তুলনায় মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী ভিন্ন, অনেকটা সাদামাটা। তাই পর্যটকদের ভিড় নেই। তবে আমাদের বেশ ভাল লাগল। ভেতরের গঠনকাঠামো মনোযোগ দিয়ে দেখলাম বেশ খানিকটা সময় নিয়ে।

ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় সবাই হোটেলের সামনে দাঁড়ালাম। এর আগে হোটেলের সামনের একটা মসজিদে মাগরিবের নামায আদায় করেছিলাম। বিদায়ের সুর বেজে উঠছিল প্রতিটি প্রাণে। আমরা যারা এককভাবে সফর করছিলাম তারা বাসের একেবারে পেছনের আসন পেলাম। আমি পেলাম (J1) আর আমার পাশেই সোহাগ ভাই (J2)। সামনের সিটে মুনতাসিম ভাই আর সাইফুল ভাই। মাওয়া ফেরিঘাটে যখন আমাদের বাসের সিরিয়াল পড়ল তখন সবাই মিলে রাতের খাবার খেতে নেমে পড়লাম। একটা ছো্ট্ট হোটেলে বসে পরটা, খিচুড়ি আর ভাত খাওয়ার অপশন থেকে যে যার মত খেয়ে নিলাম। এরই মধ্যে মারূফ ভাই খবর দিলেন বাস ফেরিতে ওঠার শেষ সিরিয়ালে আছে। আমরা ভেবেছিলাম অনেক সময় লাগবে কিন্তু ফেরির ওখানে গিয়ে দেখি ফেরি ছাড়ল বলে। তাড়াহুড়ো করে সবাই ফেরিতে উঠলাম। একটুর জন্য ট্যুরের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি থেকে বেঁচে গেলাম। তারপর অপেক্ষার পালা। একটা ফেরি নদীতে দুই ঘণ্টা সময় থাকে ভাবতেই অবাক লাগে। আমরা বড় ফেরিটার ইঞ্জিনের ‍দোতলায় উঠে পড়লাম। বেশ ভাল লাগছিল। আরিয়ান ভাই, রেখা আপু, সাত্তার ভাই, মারুফ ভাই, সাদ ভাই, মিসেস সাদ, মাহি ভাই, মিসেস মাহি, সাইফুল ভাই, মুনতাসিম ভাই আর ফটোগ্রাফার সোহাগ ভাই মিলে সেই ফেরির বিরক্তিকর সময়টা কিভাবে যেন পাড় করে দিলাম। মারূফ ভাই বলছিলেন বিক্রমপুরের কথা। বিক্রমপুর আমাদের ফেরির রুটের পাশের এলাকা। খুব বেশি দূরে নয় মারূফ ভাইয়ের বাড়ি। ফেরি ঘাটে ভেড়ার আগেই সবাই সময়মতো বাসে চড়লাম। তারপর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ঢাকার সায়দাবাদ বাস টার্মিনালে পৌঁছে গেলাম, তাও আবার রাত ৩টায়। শেষ হল অসাধারণ এক অ্যাডভেঞ্চার।